রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১২ সালে ফারমার্স ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে। চার বছরে দুর্নীতির কারণে ব্যাংকটি মৃত্যুশয্যায় পৌঁছালে ২০১৭ সালের নভেম্বরে চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন তিনি। নতুন চেয়ারম্যান হয়ে আসেন নাফিজ সরাফত। বিদেশি বিনিয়োগ আনার আশ্বাসে ব্যাংকটিকে অনেক নীতি ছাড় দেয় গভর্নর ফজলে কবিরের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ৭১৫ কোটি টাকা দিয়ে ব্যাংকটির ৬৫ শতাংশ শেয়ার নেয় সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও আইসিবি।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ফারমার্সের নাম রাখা হয় পদ্মা। কিন্তু নাফিজের ছয় বছরে ব্যাংকটি আরও খারাপ হয়। খেলাপি ঋণ ৬২ শতাংশ। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংক ছেড়ে চলে যান তিনি। অভিযোগ আছে, স্ট্র্যাটেজিক ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্টের নামে নাফিজ সরাফত পদ্মা ব্যাংক থেকে কয়েক শ কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছেন। শুধু ‘অলটারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড অব বাংলাদেশ’ নামে একটি বিকল্প তহবিলের নামে পদ্মা ব্যাংক থেকে ২০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ স্থানান্তর করা হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক পদ্মা ফরেনসিক অডিটে পায় পদ্মা ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। দুই বিদেশি অডিট কোম্পানির তদন্তে উঠে এসেছে ভুয়া ঋণ জালিয়াতির প্রমাণ। অডিট রিপোর্টে দেখা যায়, নাফিজ সরাফত ব্যাংকটির দায়িত্ব নেওয়ার পর, ৮৪ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। এই কর্মকর্তারা ব্যাংকে বসতেন না, কোনো দায়িত্বও ছিল না তাদের। নাফিস সরাফত শুধু তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে নেন। প্রতিটি পরিচয়পত্রের বিপরীতে পদ্মা ব্যাংক থেকে ৩৪৮ কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হয়। যে টাকা পুরোটাই আত্মসাৎ করেন নাফিস। ওইসব তথাকথিত কর্মকর্তার নামে নানারকম ভুয়া কোম্পানির মাধ্যমে এসব টাকা আত্মসাৎ করা হয়। যাদের নামে ঋণ নেওয়া হয়েছে, তারা জানেনও না যে এই অর্থ কে তুলেছে এবং কার কাছ গেছে। এভাবে পদ্মা ব্যাংক দ্বিতীয়বারের মতো লুট হয়। পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফত ব্যাংকটি থেকে ২৪৫ কোটি টাকা স্ট্র্যাটেজিক ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড (এসইএমএল) নামক একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে সরিয়ে নেন। এ কোম্পানির মালিক তার স্ত্রী আঞ্জুুমান আরা সাহিদ। তিনি এখানেই থেমে থাকেননি। ওই টাকা এসইএমএল থেকে একটি নতুন নন-ব্যাংক ফাইন্যান্স কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন, যেখানে তার স্ত্রী এবং ছেলে রাহিব সাফওয়ান সরাফত চৌধুরী দুজনেই শেয়ারহোল্ডার।
স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড (এসএফআইএল) নামক এ নতুন নন-ব্যাংক ফাইন্যান্স কোম্পানিটি নাফিজ প্রতিষ্ঠা করেন ২০২০ সালে। এ সময় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় অবস্থিত দুটি বিদেশি সংস্থাকে এটির শেয়ারহোল্ডার হিসেবে মিথ্যা দাবি করেন।
এসএফআইএল-এর তালিকায় কানাডিয়ান ম্যাপল স্ট্র্যাটেজিক ওয়েলথ ম্যানেজমেন্ট এলপি এবং যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক স্ট্যাটিস্টিকার ইনক নামক দুটি কোম্পানির ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ এবং ৫০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে, অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ দুটি কোম্পানিই কাল্পনিক। এসএফআইএল-এর ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল, উভয় বিদেশি কোম্পানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশনে নিবন্ধিত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কানাডিয়ান এবং মার্কিন এক্সচেঞ্জে এমন কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত নেই। এ ছাড়া এসব বিদেশি বিনিয়োগকারী কোম্পানির প্রতিনিধিরা নাফিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলেও বেরিয়ে এসেছে।
ওভারল্যাপিং শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে আন্তঃসংযুক্ত কোম্পানির একটি জাল তৈরি করেছিলেন নাফিজ। এসএফআইএল-এর কয়েকজন পরিচালক নাফিজের প্রতিষ্ঠিত কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধি ছিলেন।
২০০১ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের অগ্রাধিকার ব্যাংকিং প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা নাফিজ ২০০৯ সালে লাইসেন্স পাওয়া পদ্মা ব্যাংকের (আগে ফারমার্স ব্যাংক নামে পরিচিত) একজন শেয়ারহোল্ডার পরিচালক হন। ২০১৩ সালে পদ্মা ব্যাংকের যাত্রা শুরুর পর নাফিজ ব্যাংকটির স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার হন। তিনি তার সম্পদ ব্যবস্থাপনা ফার্ম রেস পরিচালিত ফার্স্ট বাংলাদেশ ফিক্সড ইনকাম ফান্ডের প্রতিনিধিত্ব করেন।
পদ্মা ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার জন্য জমা দেওয়া তার জীবনীতে নাফিজ রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ২৪.২৫ শতাংশ মালিকানার কথা উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো একটি চিঠি অনুসারে, নাফিজ ২০১৫ সালে পদ্মা ব্যাংকের বোর্ডে যোগ দেন এবং অডিট কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। এরপর নাফিজ রেসসহ তার বিভিন্ন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে বিনিয়োগের আড়ালে পদ্মা ব্যাংক থেকে তহবিল সরানো শুরু করেন। এসব বিনিয়োগ পদ্মা ব্যাংকের জন্য উল্লেখযোগ্য রিটার্ন আনতে পারেনি, ফলে ব্যাংকটিতে গুরুতর তারল্য সংকট দেখা দেয়, যা শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের পতনের কারণ হয়।
২০১৭ সাল নাগাদ দুর্বল বিনিয়োগ এবং ঋণ দুর্নীতির কারণে পদ্মা ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়। ব্যাংকটি না তার বিনিয়োগকৃত তহবিল ফিরে পেয়েছিল, না এসব বিনিয়োগ থেকে কোনো রিটার্ন আদায় করতে পেরেছিল।
পরে, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে নাফিজ ছাড়া ১৯ জন প্রতিষ্ঠাতা পরিচালককে অপসারণ করে ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করে। ঋণ দুর্নীতি এবং তহবিল অব্যবস্থাপনার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও গভর্নর ফজলে কবিরের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ব্যাংক নাফিজকে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করেছিল। এভাবেই কোনো ব্যক্তিগত অর্থ বিনিয়োগ না করেই নাফিজ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ব্যাংক যখন দেউলিয়া তখন তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারকে দিয়ে এ ব্যাংককে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার ব্যবস্থা করেন নাফিজ সরাফত।
পদ্মা ব্যাংকের পর নাফিজ সরাফতের নজর পড়ে সাউথইস্ট ব্যাংকের দিকে। ব্যাংকটির সাবেক দুই চেয়ারম্যান এম এ কাশেম ও আজিমুদ্দিন আহমেদকে কৌশলে পর্ষদ থেকে সরিয়ে দেন তিনি। সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়ে আসেন আলমগীর কবির। নাফিজ সরাফতের স্ত্রী আঞ্জুমান আরা সাহিদ হন পরিচালক। ছেলে চৌধুরী রাহিব সরাফতকে ব্যাংকটির পরিচালক করতে চাইলেও অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে তা হয়নি।
ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী অনেক ব্যবসায়ীর মতো নাফিজ সরাফাতের বিষয়েও অনুসন্ধান শুরু করে। তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে, অর্থ পাচার প্রতিরোধের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। গত বছরের আগস্টেই নাফিজ ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়। এক সময় যাকে স্পর্শ করা যেত না এবং অনিয়মের সংবাদ প্রকাশিত হলে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সাংবাদিকদের ভয়ভীতি দেখানো হতো, সেই নাফিজ সরাফত গা বাঁচাতে পাড়ি জমান বিদেশে।
প্রাথমিকভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যাংক দখল ও শেয়ারবাজার থেকে অর্থ লোপাটের মাধ্যমে ৮৮৭ কোটি টাকা আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অভিযোগের অনুসন্ধানে নামে দুদক। অনুসন্ধানে ৫২টি কোম্পানিতে তার ও তার পরিবারের বিনিয়োগের তথ্য খুঁজে পেয়েছেন তদন্তকারীরা। তার বিষয়ে অনুসন্ধানের সঙ্গে যুক্ত দুদকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘নামে-বেনামে যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই নাফিজ সরাফত কোম্পানির অংশীদারত্ব নিয়েছেন। কখনো অর্থের বিনিময়ে, কখনো ভয়ভীতি প্রদর্শন করে।