বিশ্ব আজ মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার। এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই, পরিবেশসংক্রান্ত সমস্যায় আক্রান্ত নয়। তবে ধনী ও উন্নত দেশগুলোর চেয়ে দরিদ্র দেশ ও জাতি এতে বেশি বিপর্যস্ত। এটা কোনো রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে বর্তমানে আবদ্ধ নয়। এর প্রতিক্রিয়া বিশ্বজুড়ে। এর সমাধানেও বিশ্বের সব দেশ ও মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রধানত মাটি, বায়ু, পানি, বৃক্ষ এ নিয়েই পরিবেশ। অবশ্য আমাদের বাড়িঘর আশপাশ এ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, এটাও ঠিক। পরিবেশ সৃষ্টি করে বায়ু, গাছপালা, পানি তথা অন্যান্য আনুষঙ্গিক উপকরণ। পরিবেশের এ উপকরণগুলো দীর্ঘদিন ধরে অপব্যবহার ও দূষণের শিকার হয়ে পরিবেশ হচ্ছে দূষিত, আবহাওয়া হচ্ছে বিনষ্ট। বর্তমান বিশ্বে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির প্রধান কারণই হচ্ছে বিপর্যস্ত পরিবেশ। ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পরিবেশের উপাদানগুলোর যথেচ্ছ, অপরিকল্পিত ও ব্যাপক ব্যবহার, শিল্পায়ন, যন্ত্রযানের ব্যবহার, পারমাণবিক গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কৃষি ও অন্যান্য প্রয়োজনে মাটিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার, বাঁধ নির্মাণ ও নদীর গতিপথ পরিবর্তন, বৃক্ষনিধন ও বনাঞ্চল উজাড় ইত্যাদি পরিবেশের মৌল উপাদানগুলোর ওপর যে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া বিস্তার করেছে তার ফলেই দেখা দিয়েছে বিভিন্ন রকমের সমস্যা। একটু লক্ষ করলেই প্রতীয়মাণ হবে, মাটির প্রকৃতি দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। এদিকে বায়ুদূষণের ফলে বায়ুমণ্ডল ক্রমাগত উত্তপ্ত হচ্ছে এবং বায়ুর ওজনস্তরে ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে।
এদিকে বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড়ের ফলে ঋতুচক্রে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে, পানির অভাবে মরুকরণ ও লবণাক্ততা বিস্তার লাভ করছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলেই বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প প্রভৃতি ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ, গাছপালা, জীবজন্তুর মধ্যে বিভিন্ন রোগব্যাধির প্রকোপ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
একসময় মানুষ পারমাণবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন ছিল। আজ পরিবেশ বিপর্যয়েও তেমনি মানবজাতি উদ্বিগ্ন। ইতোমধ্যে অবশ্য এ ব্যাপারে বেশ তোড়জোড় শুরু হয়েছে। অনুষ্ঠিত হচ্ছে সভা-সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিশ্বের সব দেশেই সংঘ, সমিতি গঠিত হচ্ছে। পরিবেশ ও প্রকৃতির উন্নয়নে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা চলছে। এটাকে একটা আন্তর্জাতিক আন্দোলনে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। এদিকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে পরিবেশসংক্রান্ত নানা কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। এসব উদ্যোগ ও প্রয়াস কিছুটা হলেও সবার মনে আশার সঞ্চার করেছে।
আমাদের দেশ বাংলাদেশ। বহু কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশ। এ দেশে দারিদ্র্য, জনসংখ্যার চাপে ব্যাপক বৃক্ষনিধন, ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ-সর্বোপরি সাধারণ মানুষের মনে সচেতনতা না থাকায় পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। এরপর রয়েছে নদীর উজান দিকে বিভিন্ন নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোর প্রভাব। এসব বাঁধের প্রভাবে ক্ষুদ্রাকার আমাদের এ দেশের গোটা একটা অঞ্চল আজ মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন। ইতোমধ্যে গোটা অঞ্চলজুড়ে মরুকরণ শুরু হয়েছে। প্রয়োজনীয় পানির অভাবে মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়েছে। প্রাণিকুল এবং নদনদীর নাব্য রক্ষার্থে যে পানির প্রয়োজন, তা আজকেই অনেক জাতের পশুপাখির বিলুপ্তি ঘটছে।
মোদ্দা কথা, বর্তমানে বাংলাদেশের পরিবেশে যে ভারসাম্যতার লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়েছে, তাতে আমাদের চিন্তাভাবনার সময় এসেছে। অবিলম্বে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আরও বেশি তৎপর ও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। আমাদের দেশে যেভাবে বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে, বন্যপ্রাণী ও বনজসম্পদ যেভাবে নিধন করা হচ্ছে, প্রকৃতি সেই স্বেচ্ছাচারিতা কত দিন সইবে, তা প্রকৃতিই ভালো বলতে পারে। তবে এটা ঠিক, আমরা সচেতনতার সঙ্গে এগিয়ে না এলে আমাদের মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হতেই হবে। আমাদের উচিত যেখানেই সম্ভব বৃক্ষচারা রোপণ করে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে বনাঞ্চল সৃষ্টি করতে হবে।
পুকুর, জলাশয়, নদীনালা, খালবিল ভরাট না করে তা সংস্কারের মাধ্যমে পরিবেশ সুস্থ-সবল রাখার প্রয়াস চালাতে হবে। সরকারের একার পক্ষে এ কাজ করে সফলতা অর্জন কঠিন। আমরা যে অবস্থানে থাকি না কেন, আমাদের দায়িত্ব নিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতির অস্তিত্বরক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশ আমাদের একটাই। আমাদের আর যাওয়ার জায়গা নেই। তাই এ দেশকেই ভালোবাসতে হবে।
টিকে থাকার জন্য প্রকৃতি ও পরিবেশকে সবল, সুস্থ ও সুন্দর রাখতে হবে-না হয় একদিন আসবে যেদিন হয়তো দেশের অস্তিত্বই থাকবে না, তখন আমরা কোথায় যাব? আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা কি আমাদের অভিশাপ দেবে না?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট