বদরের যুদ্ধকালে রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় তাঁবুতে নামাজ ও সেজদায় নতশির হয়ে থাকেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে মোনাজাত ও প্রার্থনায় ব্যাকুল হয়ে পড়েন। খন্দকের যুদ্ধে আনুমানিক তিন দিন মোনাজাতে অশ্রুসিক্ত হন। এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে ইসলামের প্রতিটি যুদ্ধে আল্লাহপাকের নির্দেশক্রমেই রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অংশগ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং পরাজয়ের কোনো প্রকার আশঙ্কা তখন ছিল না। তথাপি রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত অস্থির ও বিচলিত হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে আল্লাহপাকের দরবারে মোনাজাতে বলেন, ‘হে প্রভু! যদি আজ বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয় হয় তাহলে তোমার আনুগত্যকারী আর কেউ পৃথিবীতে থাকবে না।’
এত ভয় এবং অস্থিরতার কারণ কী?
ক. শরিয়তের আলোকে বলা যায় যে যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারীর অযোগ্যতা, আল্লাহর বিধানের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন অথবা পাপাচারিতা এবং গুনাহের কারণে নির্ধারিত ও সুনিশ্চিত রহমত এবং সাহায্য স্থগিত করা হয়। যার পরিণামে পরাজিত হতে হয়। খ. যোদ্ধা এবং সৈনিকদের নৈতিক অবক্ষয়, দায়িত্বে অবহেলা অথবা গুনাহের অপরাধে পরাজয় নেমে আসে। কিন্তু বদরের যুদ্ধে এর কোনোটিই বোধগম্য নয়। কেননা রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বসম্মতভাবে নিষ্পাপ এবং যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। জাহেরি-বাতেনি উভয় দিক দিয়েই তিনি যোগ্যতম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রসুল ছিলেন। তাই স্বীয় অযোগ্যতা অথবা পাপাচারিতার ভয়ে অস্থির হয়ে ওঠা অথবা খোদায়ি সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার অনুভূতিও অস্থিরতার কারণ হতে পারে না। বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবিরা অবশ্য নিষ্পাপ ছিলেন না বটে। কিন্তু পবিত্র কোরআন এবং হাদিসের আলোকে জানা যায়, তারাও কোনো ধরনের অবহেলা করছিলেন না। কোনো প্রকার গুনাহও তাদের দ্বারা সংঘটিত হয়নি। তার বড় প্রমাণ হলো, বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা আশাতীতভাবে বিজয় অর্জনের সৌভাগ্য লাভ করেন এবং দুনিয়াতেই ক্ষমা ও জান্নাত লাভের সুসংবাদ লাভে ধন্য হন। তাহলে বদরের যুদ্ধে এ অস্থিরতা এবং অশ্রুসিক্ত মোনাজাতের কারণ কী?
গুনাহই বিজয়ের পথে বড় বাধা। রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষ্পাপ ছিলেন। সুতরাং তাঁর দিক থেকে গুনাহের অবকাশ ছিল না মোটেই। আল্লাহর পক্ষ থেকে বিজয়ের সুসংবাদের প্রতিও রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো প্রকার সন্দেহ ছিল না। তবে সাহাবায়ে কেরাম নিষ্পাপ ছিলেন না। সুতরাং তাদের দ্বারা জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে ভুলত্রুটি অথবা কোনো প্রকার গুনাহ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা একদম শূন্য ছিল না। যুদ্ধের কৌশলে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশও ছিল। যেমন ভুল বোঝাবুঝি ওহুদের যুদ্ধে হয়েছিল। কাফেরি পরাশক্তির ভরাডুবি ও মারাত্মক পরাজয় এবং নিজেদের পরম বিজয় অবলোকন করে স্বভাবগত অহমিকা এবং আমিত্ব অনুভূত হতে পারে। যেমন হয়েছিল হুনাইনের যুদ্ধে। এমতাবস্থায় আল্লাহপাকের কুদরতের প্রকাশ এবং সাহায্য বিলম্বিত হতে পারে। যেমনটা ওহুদ ও হুনাইনের যুদ্ধে হয়েছিল। রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অস্থিরতা এবং অশ্রুভরে মোনাজাত এবং কাকুতিমিনতির পেছনে এ অনুভূতি কাজ করার অবকাশ থাকতে পারে।
আনুগত্য বিজয়ের বড় উপাদান
আল্লাহপাকের অফুরন্ত নেয়ামত, জাহেরি-বাতেনি এহসানের অনুভূতি মানুষকে তার প্রতি স্বভাবগতভাবে কাতর এবং অনুগত করে তোলে। এ কারণেই পবিত্র কোরআনে বিশ্বমানবতার প্রতি খোদায়ি অফুরন্ত নেয়ামতের কথা বারবার আলোচনা করা হয়েছে। অস্বাভাবিক এবং বিপদের সময় এ আনুগত্য বিশেষ নেয়ামত। শত্রুশক্তির মোকাবিলায় যেখানে স্বীয় অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয় এমতাবস্থায় বিজয় ও সাফল্যের নিশ্চয়তা এবং সুসংবাদ, নেতৃত্বের জন্য হয় পরম শান্তির ব্যাপার। একজন অনুগত এবং বিশ্বাসী প্রতিনিধির অনুভূতি তাকে স্বীয় মনিবের প্রতি আসক্ত এবং আবেগপ্রবণ করে তোলাই স্বাভাবিক।
হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল একজন আদর্শ মানবই ছিলেন না, তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ নবী ও রসুল। তাঁর প্রতি মহান রব্বুল আলামিনের এহসান এবং অফুরন্ত নেয়ামতের অনুভূতি তাঁকে গোলামি এবং আবদিয়তের পরম স্তরে সমাসীন করেছিল। বদরের যুদ্ধে খোদায়ি পূর্ব সুসংবাদে পরাশক্তির মোকাবিলায় ঐতিহাসিক বিজয়-আবেগে তিনি কৃতজ্ঞতার শির অবনত করে চরম দীনতা-হীনতা এবং আনুগত্যই প্রকাশ করেছিলেন। এ অস্থিরতা এবং অশ্রুসিক্ত মোনাজাতের পেছনে এ রহস্য থাকাই স্বাভাবিক।
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ