কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সামর্থ্যবান নরনারীর ওপর কোরবানি ওয়াজিব। আল্লাহ ও তাঁর রসুলের শর্তহীন আনুগত্যের শিক্ষা রয়েছে কোরবানিতে। পাশাপাশি আল্লাহতায়ালার জন্য ত্যাগ ও বিসর্জনের শিক্ষাও আছে এতে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আপনি আপনার রবের উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি আদায় করুন’ (সুরা কাউসার-২)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘হে রসুল! আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য উৎসর্গিত।’ (সুরা আনআম-১৬২)। পশু জবাই করে কোরবানি করার মধ্যে এই হিকমত ও ছবকও আছে, আল্লাহর মহব্বতে নিজের সব অবৈধ চাহিদা ও পশুত্বকে কোরবানি করা এবং ত্যাগ করা। সুতরাং কোরবানি থেকে কুপ্রবৃত্তি দমনের জজবা গ্রহণ করা উচিত। তাই কোরবানির মধ্যে ইবাদতের মূল বিষয় তো আছেই, সেই সঙ্গে তাকওয়ার অনুশীলনও রয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘মনে রেখো কোরবানির পশুর গোশত অথবা রক্ত আল্লাহর কাছে কখনো পৌঁছে না; বরং তাঁর কাছে কেবল তোমাদের পরহেজগারিই পৌঁছে (সুরা হজ-৩৭)। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, কোরবানির দিনের আমলসমূহের মধ্য থেকে পশু কোরবানি করার চেয়ে কোনো আমল আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় নয়। কিয়ামতের দিন এই কোরবানিকে তার শিং, পশম, খুরসহ উপস্থিত করা হবে। আর কোরবানির রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কোরবানি কর (জামে তিরমিজি-১৪৯৩)। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি এই ইবাদত পালন করে না, তার ব্যাপারে হাদিস শরিফে কঠোর ধমকি এসেছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যার কোরবানি করার সামর্থ্য আছে তবু সে কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (মুস্তাদরাকে হাকেম-৭৬৩৯)।
প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নরনারী, যে ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজন অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। টাকাপয়সা, সোনা-রুপা, অলংকার, বর্তমানে বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সব আসবাব কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য। আর নিসাব হলো স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত ভরি, রুপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন ভরি। টাকাপয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হলো সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রুপা কিংবা টাকাপয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায়, তাহলেও তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। একান্নভুক্ত পরিবারের মধ্যে একাধিক ব্যক্তির ওপর কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত পাওয়া গেলে অর্থাৎ তাদের কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে তাদের প্রত্যেকের ওপর ভিন্ন ভিন্ন কোরবানি ওয়াজিব। পরিবারের যত সদস্যের ওপর কোরবানি ওয়াজিব তাদের প্রত্যেককেই একটি করে পশু কোরবানি করতে হবে কিংবা বড় পশুতে পৃথক পৃথক অংশ দিতে হবে। একটি কোরবানি সবার জন্য যথেষ্ট হবে না। কোরবানির নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কোরবানির তিন দিন থাকলে এমনকি ১২ তারিখ সূর্যাস্তের কিছু আগে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে গেলেও কোরবানি ওয়াজিব হবে (বাদায়েউস সানায়ে চতুর্থ খণ্ড, ১৯৬ পৃষ্ঠা, রদ্দুল মুহতার ষষ্ঠ খণ্ড, ৩১২ পৃষ্ঠা। )
জিলহজ মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগপর্যন্ত মোট তিন দিন কোরবানির সময়। তবে সবচেয়ে উত্তম হলো প্রথম দিন কোরবানি করা। যেসব এলাকার লোকদের ওপর জুমা ও ঈদের নামাজ ওয়াজিব তাদের জন্য ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করা জায়েজ নয়। অবশ্য বৃষ্টিবাদল বা অন্য কোনো ওজরে যদি প্রথম দিন ঈদের নামাজ না হয় তাহলে ঈদের নামাজ আদায় পরিমাণ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম দিনেও কোরবানি করা জায়েজ (ফতোয়ায়ে কাজিখান, তৃতীয় খণ্ড, ৩৪৪ পৃষ্ঠা)।
কেউ যদি কোরবানির দিনগুলোতে ওয়াজিব কোরবানি দিতে না পারে তাহলে কোরবানির পশু ক্রয় না করে থাকলে তার ওপর কোরবানির উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। আর যদি পশু ক্রয় করেছিল, কিন্তু কোনো কারণে কোরবানি দেওয়া হয়নি তাহলে ওই পশু জীবিত সদকা করে দেবে (বাদায়েউস সানায়ে, চতুর্থ খণ্ড, ২০৪ পৃষ্ঠা)। উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কোরবানি জায়েজ নয়। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল (সা.) আমাদের নির্দেশ করেছেন, আমরা একটি গরু এবং একটি উটে সাতজন করে শরিক হয়ে যাই (মুসলিম-১২১৮)।
লেখক : খতিব, আমলীগোলা জামে মসজিদ, লালবাগ, ঢাকা