আন্দোলন, গণ অভ্যুত্থান কিংবা বিপ্লব নামের এক রাজনৈতিক সুনামি গত আগস্টে পাল্টে দিয়েছিল দেশের প্রেক্ষাপট। বিশ্ববরেণ্য এক নোবেল বিজয়ীর নেতৃত্বে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মেধাবীদের নিয়ে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকারকে ক্ষমতায় দেখে দেশ, জাতি এমনকি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধুরা স্বস্তি পেয়েছিল। সবাই ভেবেছিল দেরিতে হলেও বাংলাদেশ সৌভাগ্যবান যে এমন কিছু সুশীল ও সৎ মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকবে দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষ, যার বড় অংশই কর্মঠ ও তরুণ।
কিন্তু ২৭ মে সকালে যখন লিখতে বসেছি, তখন সার্বিক পরিস্থিতি দেখে বোঝা যায় রাজনৈতিক সুনামি না হোক, কমপক্ষে রাজনৈতিক কালবৈশাখি হয়তো ধেয়ে আসছে। অথচ বিপৎসংকেত দেখিয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করার ব্যবস্থাপনাও যেন বিকল।
২৭ জুন ১৭৫৭ সালে ইংরেজ আর মীরজাফর গংদের হাতে ভাগীরথীর তীরে দাঁড়িয়ে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের আগে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা বলেছিলেন, ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। তার শ্যামল প্রান্তরে আজ রক্তের আলপনা। জাতির সৌভাগ্য সূর্য আজ অস্তাচলগামী...।’ সেই ঘটনার প্রায় ২৬৮ বছর পর বিভিন্ন গণমাধ্যমের আশঙ্কা ছড়ানো সংবাদ শিরোনাম দেখে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তাণ্ডব দেখে শঙ্কা ও প্রশ্ন জাগে বাংলার ভাগ্যাকাশে কি আবারও দুর্যোগের ঘনঘটা? আবারও কি বৃষ্টির পানি আর মানুষের রক্তে সিক্ত হতে চলেছে দেশের পবিত্র মাটি? জাতির সৌভাগ্য সূর্য কি অস্তগামী?
দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম সোপান প্রাথমিক শিক্ষা। বাল্যকালে বা শিশুমনে যে চিন্তা-চেতনা জন্ম নেয়, তার প্রভাব থেকে যায় জীবনভর। সেই শিশুরা আজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। তাদের শিক্ষকরা নিজেদের দাবিদাওয়া না মানা হলে বিদ্যালয়মুখী হবেন না। গোল্লায় যাক বাচ্চাদের লেখাপড়া! দাবি মানতে হবে সবার আগে। বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কখনো রাতে মূল ক্যাম্পাসের বাইরে ছাত্র হত্যা, কখনো উপাচার্য হটানোর দাবিতে অচল করছে এক একটি বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মতো সম্মানিত ও স্পর্শকাতর শিক্ষাবিদ উন্মত্ত ছাত্রদের শান্ত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘মার বেটা আমাকে, মার’। (সূত্র : দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৪ মে)। শিক্ষাব্যবস্থায় দুর্যোগের ঘনঘটা আন্দাজের জন্য এই একটি সংলাপই কি যথেষ্ট নয়?
রাজধানীর একাংশে দক্ষিণের সিটি করপোরেশনে মেয়র পদায়ন নিয়ে চলছে অচলাবস্থা। রাজনৈতিক কর্মীরা রাস্তাঘাট ও নগর ভবন ঘেরাও করে প্রায় পাঁচ বছর আগের নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীকে গদিতে বসাতে চায়। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন নগর ভবনের কর্মকর্তা ও মাঠপর্যায়ের সেবাদানকারী কর্মীরা। বসবাসের অযোগ্য ও অন্যতম দূষিত নগরীর তকমা পাওয়া ঢাকার নাগরিকদের আজ ভোগান্তির শেষ নেই। ভেঙে পড়েছে নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। অটোরিকশাচালকদের ধমকে খাটো হয়ে আছে ট্রাফিক সার্জেন্টরা।
প্রশাসনের হৃৎপিণ্ড সচিবালয় আর অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড জাতীয় রাজস্ব ভবন। সুরম্য এ দুটি ভবনই আজ আন্দোলন, অবরোধ আর আলটিমেটামের উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। সচিবালয়ে কলমবিরতি পালন করছেন ছয়টি ক্যাডারের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তাদের প্রতি মৌন সমর্থন প্রকাশ করেছে অন্য ক্যাডারের সরকারি বেতনভুক্তরা। ২৭ মে প্রশাসন ক্যাডার কর্তৃক বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে অন্য ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কলমবিরতি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড রাজস্ব ভবনে চলছে আরেক তুঘলকি কাণ্ড। অর্থবছরের শেষে এক স্পর্শকাতর সময়ে এসে রাজস্ব আদায় বন্ধ ছিল লম্বা সময়জুড়ে। প্রথমে আন্দোলনকারীদের ছিল প্রশাসনিক সংস্কার বাতিলের দাবি। সরকার তা মেনে নিলে সামনে আসে পরে উত্থাপিত চেয়ারম্যানকে সরানোর দাবি। অথচ দীর্ঘদিন পর অন্য বিভাগ তথা প্রশাসন ক্যাডারের বদলে নিজেদের রাজস্ব ক্যাডারের একজনকে চেয়ারম্যান হিসেবে পেয়েছে রাজস্ব বিভাগের কর্মীরা। ওয়েবসাইটের তথ্যমতে চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও আমেরিকা, ইংল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার পাঁচটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ পেয়েছেন। এ ছাড়াও তিনি একজন সফল চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য প্রস্তুতকৃত হিসাব বিবরণী কিংবা শেয়ার বাজারে অন্তর্ভুক্তির জন্য বানানো কৃত্রিম অডিট রিপোর্ট যাচাইবাছাইয়ে তার চেয়ে দক্ষ আর কে হতে পারে? অথচ এমন বিদ্বান ও পেশাদার হিসাববিদের বিরুদ্ধে আজ এক একটা হয়েছে এনবিআরের একাংশ। অপ্রিয় হলেও সত্য, ভাইরাল ছাগলকাণ্ড ঘটানো মতিউর রহমানের বিষয়ে আন্দোলনকারীরা কখনো একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি।
বড় অদ্ভুত এ দেশের সরকারি শিক্ষক, ডাক্তার, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তারা সারা দিনের বেতন নেবেন, সরকারি গাড়িতে করে কর্মক্ষেত্রে আসবেন এবং কর্মক্ষেত্রের বারান্দা সিঁড়ি কিংবা খোলা জায়গা ব্যবহার করে কর্মবিরতি পালন করবেন। কেউ কেউ হয়তোবা কর্মবিরতি কালের জন্য ওভারটাইমও পেয়ে যাবেন। রোধ করতে গেলেই রোষানলে পড়বেন সৎ কর্মকর্তারা।
উত্তেজনা বিরাজ করছে সীমান্তজুড়েও। চারদিক থেকে বন্যার পানির মতো দেশে ‘পুশইন’ করে ভারতে দীর্ঘদিন ধরে থাকা আবালবৃদ্ধবনিতাদের অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে। চট্টগ্রামে সেলাই হচ্ছে সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কুকি চিন আর্মি বা কেএনএফ সেনাদের ইউনিফর্ম। আরাকান আর্মি ধরে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের জেলেদের। করিডর ও বন্দর প্রশ্নে মুখোমুখি সেনাবাহিনী ও অন্তর্বর্তী সরকারের একাংশ। সেনা অফিসারদের সঙ্গে বলা সেনাবাহিনী প্রধানের কথা মুহূর্তেই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই বলছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার পর থেকে একপ্রকার যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আছে বাংলাদেশ। আর যুদ্ধের প্রধান সেনাপতিকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাচ্ছেতাই মন্তব্য করে যাচ্ছে বিভিন্ন কুচক্রী মহল।
দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে দেওয়া হচ্ছে মর্মে ইস্যু তৈরি করে আমদানি-রপ্তানি বন্ধের হুমকি দিচ্ছেন শ্রমিক ও অন্য অংশীজনরা। দেশের রপ্তানি ব্যাহত করতে প্রতিবেশী দেশ ভারত একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে বাংলাদেশি পণ্যের ভারতে প্রবেশের ওপর। গ্যাসের অভাবে বন্ধ শিল্প-কলকারখানাগুলো মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। শিল্পপতিরা নিজেদের ‘জিন্দা লাশ’ দাবি করে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছেন।
সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলার আকাশে আজ রাজনৈতিক দুর্যোগের ঘনঘটা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি সফল মডেল। তবে রাজনৈতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের অর্থনীতি, প্রশাসন, রাজনৈতিক শক্তি কিংবা সামরিক শক্তির প্রস্তুতি কতটুকু এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। দেশে সম্ভবত অন্যতম ভালো খবর হলো, আসন্ন কোরবানির ঈদে খুব বড় বাজেটের এবং বড় ক্যানভাসের সিনেমা মুক্তি পেতে চলেছে, যার নাম ‘তাণ্ডব’। একাগ্রচিত্তে প্রার্থনা করি- ‘এই তাণ্ডব, তুমি কেবল সিনেমার পর্দাতেই সীমাবদ্ধ থাক। সচিবালয়, রাজস্ব ভবন, নগর ভবন, শিক্ষাঙ্গন, সীমান্ত, বন্দর কিংবা রাজপথে যেন তোমার দেখা না পাই।’ সম্প্রতি নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের দেওয়া একটি অডিও সাক্ষাৎকার ভারতীয় প্রচারমাধ্যমের কল্যাণে নেট জগতে ভেসে বেড়াচ্ছে। এ সাক্ষাৎকারের একটি অংশে ওবায়দুল কাদের নিজেই বলেছেন, ৫ আগস্টের পর তিনি তিন মাস বাংলাদেশে ছিলেন- গার্মেন্টসহ বিভিন্ন সেক্টরের মাধ্যমে তখন অরাজকতা সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় আন্দোলন করা অন্যান্য সেক্টরের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। আজ থেকে সেই পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও শহীদ মিনারে সমাবেশ ঘটিয়ে কর্মবিরতিসহ নানা কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]