দেশীয় শোবিজ ইন্ডাস্ট্রিতে নবীন শিল্পীর কাজ বেড়েছে। পারিশ্রমিকও বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্তু বেশির ভাগ সিনিয়র অভিনয় শিল্পীর হাতে তেমন কাজ নেই। পারিশ্রমিকও আগের মতো বাড়ছে না। এমনকি পর্দায় তাঁদের চরিত্রের ব্যাপ্তিও কমে এসেছে। গল্পে তাঁদের চরিত্র রাখাকে প্রয়োজন মনে করছেন না নাট্যনির্মাতা, প্রযোজক, অডিও প্রযোজনা সংস্থা, বিজ্ঞাপন এজেন্সি বা চ্যানেল মালিকরা। ফলে এসব শিল্পীর কাজ ও মেধার সঠিকভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে না ইন্ডাস্ট্রিতে। এমনিতে এসব শিল্পীর আয়ের কোনো উৎস নেই। অভিনয় করেই সংসার চলে। কিন্তু কাজ না থাকায় তাঁরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আবার ঠিকমতো পারিশ্রমিক না পেয়ে হতাশায় ডুবে আছেন কেউ কেউ। অথচ তাঁরা অভিনয়কে ভালোবেসে এই পেশায় এসেছেন। সম্প্রতি ছোট ও বড়পর্দার সিনিয়র অভিনেত্রী শিখা খান মৌয়ের হতাশা ও আক্ষেপের খবর সবার নজরে আসে। এরপরই ইন্ডাস্ট্রির সবাই নড়েচড়ে বসেছেন।
বেশ কয়েক মাস আগে অভিনয়ে বেশ ব্যস্ত সময় পার করলেও দীর্ঘ সময় ধরে কাজহীন ছিলেন শিখা খান মৌ। সে সময় নিজের এ অবস্থা নিয়ে গণমাধ্যমে বলেন, ‘অনেক বছর থেকে অভিনয় করে আসছি। এতদিন নিজেকে অভিনেত্রী হিসেবেই জানতাম, কিন্তু গত আড়াই মাস ধরে নিজেকে অভিনেত্রী ভাবতে লজ্জা হচ্ছে। আগে যেখানে মাসে ১৫ থেকে ২০ দিন কাজ করতাম সেখানে আড়াই মাস যাবৎ মাসে চার থেকে পাঁচ দিন কাজ করছি। তাহলে কীভাবে মনে হবে আমি অভিনয় শিল্পী? অভিনয় করেই আমার সংসার চলে। তবে আমি জানি বেঁচে থাকতে আমার মূল্যায়ন করা না হলেও আমার মৃত্যুর পর কিছু মানুষ হলেও আমাকে মনে রাখবে। হয়তো বলবে আহারে মহিলা তো কত ভালো ছিল, কত সহজ সরল ছিল, কারও সাতপাঁচে ছিল না; কারও সামনে-পেছনে ছিল না। আহারে মহিলাটির আত্মার শান্তি পাক। কিন্তু তাতে কী লাভ হবে আমার। বেঁচে থাকতে তো দরকার আমার কাজের, বেঁচে থাকতেই দেখে যেতে চাই আমার মূল্যায়ন হচ্ছে। কিন্তু সেটা কি আদৌ দেখে যেতে পারব, আমি জানি না। তবে আমার অনুরোধ, আমি মরে গেলে দয়া করে কেউ আফসোস করবেন না। আমাকে মনে করারও কোনো দরকার নেই।’ দীর্ঘ ২৫ বছরে একই পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন উল্লেখ করে জানান, ‘হঠাৎ করে কেন কাজ কমে গেল? কেন আমাকে ডিরেক্টররা ডাকছেন না, মনে করছেন না কেন। তাদের গল্পের চরিত্রের সঙ্গে আমি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারব। আমি তো আমার রেমুনারেশন বাড়াইনি। ২৫ বছর যাবৎ মিডিয়ায় আছি। এখনো আমার রেমুনারেশন মাত্র ৫ হাজার টাকা। এটাও কি খুব বেশি? যাই হোক যত দিন বাঁচি কাজ করে যেতে চাই। আপনারা ব্যাপারটা দেখবেন। আমার সহকর্মী যারা আছেন তারা আমার ব্যাপারটা দেখে একটু সাহায্য করবেন। একটা শিল্পীর জন্য হঠাৎ করে কাজ কমে যাওয়া কম কিছু না। আপনারা পাশে থেকে আমাকে সাহায্য করবেন।’ এদিকে অভিনেত্রী শিখা মৌ এই হতাশা ও ক্ষোভের পর তার ভক্ত, অনুরাগী ও সহকর্মী তারকারা তার পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। গতকাল খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শিখা মৌ একটি শুটিংয়ে ব্যস্ত। কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘অনেক দিন ধরে কাজহীন ছিলাম। তাই হতাশায় কথাগুলো বলেছি। এখন আবার কাজ করছি। তবে নিয়মিতভাবে কাজ করে যেতে চাই।’ খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, শিখা খান মৌয়ের মতো এমন অনেক শিল্পী রয়েছেন, যারা কাজহীন। তবে লোকলজ্জার কারণে তাদের দুর্দশার কথা কাউকে বলছেন না। যেমন কাজের মূল্যায়নের অভাবে এখন পর্দায় তেমন করে দেখা যায় না খালেদা আক্তার কল্পনা, রেহানা জলি, আনোয়ারা, সমু চৌধুরী, আমিরুল হক চৌধুরী, রাইসুল ইসলাম আসাদ, সুজাতা, ডলি জহুর, খায়রুল আলম সবুজের মতো সিনিয়রদের। আবুল হায়াত, দিলারা জামান, শিরিন আলম, তারিক আনাম, মনিরা মিঠু, সাবেরী আলম, নরেশ ভূইয়া, শিল্পী সরকার অপু, মিলি বাসার, মাসুম বাসার, রেশমা, আবদুল্লাহ রানার মতো কেউ কেউ কাজ করলেও বাকিরা তেমন করে কাজ করছেন না। অন্যদিকে চলচ্চিত্রের বেশির ভাগ সিনিয়র শিল্পী তো কাজহীন। এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে গুণী অভিনেতা আবুল হায়াত বলেন, ‘সিনিয়র শিল্পীদের প্রতি চরম অবহেলা করা হচ্ছে। শিল্পের প্রতি যাদের ভালোবাসা, তারা কি নাটক বানাচ্ছেন? সিনিয়র শিল্পীদের এসব নাটকে কি প্রয়োজন? নাটকে নেই ভাই-বোন, মা-বাবা, শিশু বা দাদা-দাদি। বলতে গেলে তো অনেক ক্ষোভের কথা বলতে হয়! সেদিনকার ছেলেমেয়ে এসেই চার-পাঁচ গুণ বেশি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। নেবে সমস্যা নেই, তবে একটা ভারসাম্য থাকা উচিত।’ দিলারা জামান বলেন, ‘বাজেট স্বল্পতা দেখিয়ে নির্মাতারা দিনে দিনে এই চরিত্র কাটছাঁট করছেন। তিন-চারজনকে নিয়ে নাটক বানাচ্ছেন। নির্মাতারা এখন নাটক দুই-তিন দিনের মধ্যে শেষ করছেন, যেখানে সিনিয়র শিল্পী সংখ্যা নেই বললেই চলে। সম্মানি দিতে গেলেও সবাই টালবাহানা করে। মূল্যায়ন কমে গেছে। এখন আমাদের মতো সিনিয়রদের কাজ কমে যাচ্ছে।’ ডলি জহুর বলেন, ‘আমরা সিনিয়র অভিনয় শিল্পীরা একজন জুনিয়রের তুলনায় সম্মানি, মূল্যায়ন কম পাচ্ছি। নাটকে আমাদের চরিত্র বাদ দেওয়া হচ্ছে। আগের তুলনায় কাজও কমে গেছে। কারণ নির্মাতা, প্রযোজক বা চ্যানেল মালিক একটা গৎবাঁধা নিয়মে কাজ করছেন। টোটাল ক্ষেত্রটাই অপরিচ্ছন্ন হয়ে গেছে।’ রাইসুল ইসলাম আসাদ বলেন, ‘সিনিয়র অভিনয় শিল্পীরা সবাই বেকার হয়ে পড়েছেন। নাটকে বাবা থাকলে মা নেই, আবার মা থাকলে বাবা নেই! সিনিয়র শিল্পীদের সম্মানি, তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়ানো এখন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে।’
শিরিন আলম বলেন, ‘নাটকে চরিত্রের আধিক্য না থাকার কারণে আমাদের অনেক সিনিয়র শিল্পীই আজ বেকার। অনেকের কথা কী বলব আমি নিজেই সাফার করছি, কাজ নেই, প্রায় সময় বসে থাকতে হয়। এখনকার সময়ে সবাই নায়ক-নায়িকা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। এর সমস্যা আসলে বাজেট, আমার কাছে তাই মনে হয়। এখন নাট্যকারদের সেভাবেই বলে দেওয়া হয় গল্প লিখতে, যেখানে বাবা-মা কিংবা ভাইবোনের কোনো চরিত্রই থাকে না।’ এদিকে খায়রুল আলম সবুজ মনে করেন, সম্মানি দিয়ে মূল্যায়ন হয় না। এখনকার সময়ে যার কাটতি থাকবে তাকে সবাই নেবে। তবে সিনিয়র শিল্পীরা কেমন আছেন, কী করছেন, খোঁজ নেওয়া শিল্পীদের দায়িত্ব হওয়া উচিত। বাস্তব বিষয়টা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে নাট্যাঙ্গনে যেন এক ধরনের অদ্ভুত সুনসান নীরবতা নেমে এসেছে। একদিকে কেউ কাজ করছেন অন্যদিকে একটি অংশ অভিযোগ করছেন, মাসের পর মাস বসে আছেন। চিত্রটা যেন অনেকটা ‘কাজ আছে, আবার কাজ নেই’- নাট্যাঙ্গনে চলছে এক টানাপোড়েন। একটা সময় ছিল নির্মাতা-শিল্পীরা মাসের পর মাস শুটিংয়ে ব্যস্ত থাকতেন। টিভি চ্যানেল থেকে শুরু করে ইউটিউব পর্যন্ত এক ধরনের হাইপ তৈরি হতো। সম্প্রতি সেই চিত্র বদলে গেছে। এখন ঈদ বা উৎসবেও কাজ কমেছে, এর বাইরে বছরজুড়ে নির্মাণ সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজেটের একটা বড় অংশ যায় প্রধান শিল্পীদের পারিশ্রমিকেই। ফলে বাকি সিনিয়র শিল্পীরা কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। মূলত গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের চলমান নানা ইস্যুর কারণে কাজ কমে গেছে বলে দাবি করেছেন কেউ কেউ।
অনেকে আবার বলছেন স্পন্সরশিপ সংকট ও অনলাইন মাধ্যমে (ফেসবুক-ইউটিউবে) আয়ের রেশিও একেবারে তলানিতে নেমে আসাতেই এই কাজ কমে যাওয়া। কারণ যাই হোক না কেন মোদ্দা কথা নাটক ইন্ডাস্ট্রি এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। টেলিভিশনের পর এবার অনলাইন বিভিন্ন মাধ্যমের জন্য নাটক নির্মাণেও পড়েছে ভাটা। তবে যারা এখন নিয়মিত কাজ পাচ্ছেন, তারা মূলত অল্প সংখ্যক পরিচিত মুখ। জনপ্রিয় শিল্পীদের ঘিরেই বেশি কাজ হয়, একই পরিচালকের টিম বারবার দেখা যায়। এটাই একটা বিভক্ত বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে, যেখানে কেউ বলছেন, ‘আমরা তো কাজ করছি’, আবার কেউ বলছেন, ‘আমরা তো বসে আছি’। এর বাইরে অনেক উদীয়মান ও মধ্যম পর্যায়ের শিল্পীদেরই অভিযোগ, বছরজুড়ে হাতে গোনা কাজ পাচ্ছেন। যেগুলো দিয়ে জীবিকা চালানো প্রায় অসম্ভব।