দেশে ব্যবসাবাণিজ্যের হৃৎপিণ্ড ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। দেশের পুরো বাণিজ্য বৃহৎ এ পাইকারি বাজার থেকেই নিয়ন্ত্রণ হতো বলে একসময় একে বলা হতো ‘প্রাচ্যের ওয়াল স্ট্রিট’। কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই পাইকারি বাজারটি দশকের পর দশক দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে। চাল, ডাল, তেল, চিনি থেকে শুরু করে যাবতীয় মসলা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখান থেকেই নির্ধারিত হতো। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই প্রতাপ ও জৌলুস এখন অনেকটাই ম্লান। নানা অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক কারণে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়িক পরিধি সংকুচিত হয়ে পড়েছে, যা এক সোনালি অধ্যায়ের ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ার গল্প বলে।
খাতুনগঞ্জের উত্থানের পেছনে ছিল ভৌগোলিক অবস্থান এবং ব্যবসায়িক অবকাঠামোর অনন্য সমন্বয়। চট্টগ্রাম বন্দরের নৈকট্য এবং কর্ণফুলী নদী ও চাক্তাই খালের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পণ্য পরিবহনের সহজ ব্যবস্থা একে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছিল। এখানকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস বা ‘কথার দাম’ ছিল ব্যবসার মূল ভিত্তি। কোনো ধরনের লিখিত চুক্তি ছাড়াই কোটি কোটি টাকার লেনদেন সম্পন্ন হতো, যা এ বাজারকে দিয়েছিল স্বতন্ত্র পরিচিতি। দেশের শীর্ষস্থানীয় বহু শিল্পগোষ্ঠীর জন্ম ও বিকাশ খাতুনগঞ্জের হাত ধরেই। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যে কারণগুলো খাতুনগঞ্জকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল, সেগুলোই এখন এর পতনের কারণে হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পতনের কারণগুলোকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসার অন্যতম ভিত্তি ছিল পারস্পরিক বিশ্বাস। কিন্তু গত কয়েক দশকে এ বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্র বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা বেড়েছে। ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) এবং চেকের মাধ্যমে বাকিতে পণ্য নিয়ে টাকা পরিশোধ না করার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। ফলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থাহীনতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা এখানকার ঐতিহ্যবাহী লেনদেনব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাতুনগঞ্জের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটেনি। সরু রাস্তা, তীব্র যানজট এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ এখানকার দৈনন্দিন কার্যক্রমে স্থবিরতা এনেছে। সবচেয়ে বড় অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে জলাবদ্ধতা। সামান্য বৃষ্টি বা জোয়ারের পানিতেই তলিয়ে যায় বহু দোকান ও গুদাম। প্রতি বছর নষ্ট হয় কোটি কোটি টাকার পণ্য। একসময় পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম চাক্তাই খাল এখন ভরাট ও দূষণের শিকার। এর নাব্যতা কমে যাওয়ায় নৌপথে পণ্য পরিবহন প্রায় বন্ধের মুখে, যা খাতুনগঞ্জের মূল শক্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে।
একসময় সারা দেশ খাতুনগঞ্জের ওপর নির্ভরশীল থাকলেও এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক মৌলভীবাজার, নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন পাইকারি বাজার গড়ে উঠেছে। বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী এখন আর খাতুনগঞ্জের মাধ্যমে ব্যবসা না করে সরাসরি সারা দেশে তাদের পণ্য সরবরাহ করছে। এতে খাতুনগঞ্জের বাজারের অংশীদারি বহুলাংশে কমে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসার ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। আগে খোলা পণ্যের রমরমা ব্যবসা থাকলেও এখন মোড়কজাত পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। দেশের বড় শিল্পগ্রুপগুলো ট্রেডিং ব্যবসার পাশাপাশি শিল্প উৎপাদনে মনোযোগ দিয়েছে। তারা নিজেরাই পণ্য আমদানি করে পরিশোধন ও প্যাকেটজাতের মাধ্যমে সরাসরি বাজারে ছাড়ছে। ফলে খাতুনগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী পাইকারি ব্যবসার গুরুত্ব কমেছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাকের জন্য ওজনসীমা নির্ধারণ করে দেওয়ায় চট্টগ্রাম থেকে পণ্য পরিবহনের খরচ অন্য অঞ্চলের তুলনায় বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই নীতির কারণে আমদানিকারকরা চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবর্তে সরাসরি নারায়ণগঞ্জ বা অন্য কোথাও পণ্য খালাস করতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। এর ফলে খাতুনগঞ্জ প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাচ্ছে। এ ছাড়াও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ব্যাংক খাতে বিভিন্ন সময়ে সৃষ্ট সংকটও এখানকার ব্যবসায়ীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। চেক নগদায়নে সমস্যা এবং ঋণ প্রাপ্তিতে জটিলতা ব্যবসার স্বাভাবিক গতি ব্যাহত করেছে।
সব মিলিয়ে একসময়ের অপ্রতিরোধ্য খাতুনগঞ্জ আজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে অবতীর্ণ। অবকাঠামোগত দুর্বলতা, আস্থার সংকট, নতুন প্রতিযোগী তৈরি হওয়া এবং ব্যবসায়িক মডেলের পরিবর্তন- এই চতুর্মুখী চাপে এর সোনালি অতীত এখন কেবলই স্মৃতি। যদি দ্রুত জলাবদ্ধতা নিরসন, যানজট কমানো, চাক্তাই খাল খনন এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার মতো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হয়, তবে ‘প্রাচ্যের ওয়াল স্ট্রিট’-এর পতন হয়তো সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। খাতুনগঞ্জকে বাঁচাতে হলে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ অপরিহার্য।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী