দুই প্রতিবেশী, দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। মাঝে ছিল এক ‘বন্ধু’—যার নাম আমেরিকা। বন্ধুটি কখনো একিকে যায় তো, কখনো আবার অন্যের দিকে ঝোঁক।
সম্পর্কের এই জটিল রসায়নের নতুন নাটকীয় মোড় এসেছে হোয়াইট হাউসের অন্দরমহল থেকে। ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় ইনিংসে সেই মোড় যেন সোজা দিল্লি থেকে ঘুরে গিয়েছে ইসলামাবাদের দিকে।
এক সময় পাকিস্তানকে ‘মিথ্যেবাদী’ বলে খোঁটা দেওয়া প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হঠাৎ করে যেন খুঁজে পেয়েছেন ইসলামাবাদের সঙ্গে পুরনো কোনো হারানো আত্মীয়তা।
আর সেই আত্মীয়তার এক ঝলক দেখা গেল গত ৩০ জুলাই—যেদিন ভারতকে ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্কে ঠেলে দিয়ে ঠিক তার কিছুক্ষণ পরেই পাকিস্তানের সঙ্গে ‘বিরাট জ্বালানি চুক্তি’র ঘোষণা দিলেন প্রেসিডেন্ট সাহেব। ইসলামাবাদের ওপর বসালেন ১৯ শতাংশ শুল্ক।
ট্রাম্পের কথায়, পাকিস্তানের বিপুল খনিজ তেলের রিজার্ভকে কাজে লাগাতে আমেরিকা এবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে।”—ঠিক যেন পুরোনো প্রেমে নতুনভাবে জ্বলে ওঠা আগুন।
হঠাৎ এই মোড়?
২০১৮ সালের ডোনাল্ড ট্রাম্প কি কখনো ভাবতেন, যাঁরা ‘ধোঁকা ছাড়া কিছুই দেয় না’—তাদের সঙ্গেই একদিন এমন ঘনিষ্ঠতায় যাবেন?
কিন্তু রাজনীতি তো এমনই, যেখানে আজকের শত্রু আগামী দিনের বাণিজ্যসঙ্গী হতে বেশি সময় লাগে না।
জ্বালানি চুক্তির সঙ্গে সঙ্গে হোয়াইট হাউস থেকে আরও এক খোঁচা এসেছিল ভারতের দিকে। ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখলেন, কে জানে, একদিন হয়তো দেখা যাবে পাকিস্তান ভারতেও তেল বিক্রি করছে!
ঘরের ভেতরের গল্প
এই সম্পর্কের টানাপোড়েন কিন্তু শুধু জ্বালানিতে সীমাবদ্ধ নয়। সামরিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও চলছে একের পর এক নাটকীয় দৃশ্যপট।
অল্প কদিন আগেই পাকিস্তান তার সামরিক সম্মান 'নিশান-ই-ইমতিয়াজ' তুলে দিল মার্কিন জেনারেল কুরিলার হাতে। বলা হলো, আঞ্চলিক শান্তির স্বার্থে তার অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি।
এরপরই হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে বসেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। কী আলোচনা হয়েছিল, তা জানেন না কেউ। কিন্তু পরে জানা গেলো পাকিস্তান নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ট্রাম্পের নাম প্রস্তাব করেছে।
এই মধ্যাহ্নভোজের ঠিক পরে ওয়াশিংটনে যান পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর প্রধানও। মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকও হয়। লক্ষ্য ভারী সামরিক সরঞ্জাম। এফ-১৬ ব্লক যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক মিসাইল; সবই রয়েছে সেই তালিকায়।
ব্যবসা, নোবেল আর ক্রিপ্টো– সব মিলিয়ে এক নতুন ছক
কূটনীতিকরা বলছেন, পাকিস্তানের প্রতি ট্রাম্পের এই আচমকা মায়ার পেছনে দুটি মূল কারণ কাজ করছে।
প্রথমত, পাকিস্তান একটি মার্কিন ক্রিপ্টো ফার্মের সঙ্গে জোট বাঁধছে। যার মালিকানা ট্রাম্প পরিবারের। প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘ওয়ার্ল্ড লিবার্টি ফিনান্সিয়াল’।
দ্বিতীয়ত, সেই বহুল চর্চিত নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন। ট্রাম্প বারবার বলে আসছেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির নেপথ্যে ছিল তাঁরই মধ্যস্থতা—যদিও ভারত সরকার সেটা স্বীকার করেনি কখনো।
ভারতের কপালে চিন্তার ভাঁজ
তবে প্রশ্ন হল, এই নতুন ঘনিষ্ঠতা ভারতের জন্য কতটা উদ্বেগের?
‘কোয়াড’ জোটের অন্যতম শরিক হিসেবে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই ‘স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’-এর পর্যায়ে ছিল। চীনকে ঠেকাতে সেই সম্পর্ক ছিল অনেকটা স্তম্ভস্বরূপ।
কিন্তু ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় এসে যেন অন্য ছকে খেলতে শুরু করেছেন। তিনি চীনের সঙ্গে সরাসরি ডিল করতে চাইছেন, ভারতকে বাদ দিয়েই।
যে কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্পের মুখে 'কোয়াড' শব্দটাও তেমন একটা শোনা যাচ্ছে না। ভারতের ভূমিকা যে এখন অনেকটাই সঙ্কুচিত—তা বেশ স্পষ্ট।
শেষ কাহিনি এখনো বাকি
পাকিস্তানের সঙ্গে বাড়তে থাকা এই মধুর সম্পর্ক ভারতের জন্য একটা কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তো বটেই, সঙ্গে সামরিক দিক থেকেও বড় এক সতর্কবার্তা।
বিশেষ করে পশ্চিম সীমান্তে যদি আমেরিকা-সমর্থিত পাকিস্তান নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে—তবে ভারতের নিরাপত্তা ও স্বার্থরক্ষায় লাগবে আরও জোরালো কূটনীতি, দৃঢ় কৌশল।
আমেরিকার তার পুরনো স্বভাবই তো, যেখানে সুবিধা, সেখানেই ঘনিষ্ঠতা। বন্ধুত্ব নয় বরং দর কষাকষির কূটনৈতিক বাজারে ভারত এখন কতটা দরদাম করতে পারবে, সেটাই ভবিষ্যতের নিয়ামক।
ভূরাজনীতির এই গল্পে চরিত্রগুলো হয়তো পুরোনো, কিন্তু সম্পর্কগুলো প্রতিদিনই নতুন রং নিচ্ছে। আগামী দিনে এই রঙিন ক্যানভাসে ভারত কী ছবি আঁকবে, সেটাই এখন দেখার।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল