জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। আশা করা যায়, রোজার আগে ফেব্রুয়ারিতে ইলেকশন হবে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ৫ আগস্ট বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। গণ অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সেদিন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। বিভিন্ন সূত্রে খবর হচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে ভোটের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। ইলেকশন ডিউটি করার জন্য সেপ্টেম্বরে দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ৬০ হাজার সেনাসদস্য মাঠে থাকবেন। মোটকথা একটি ভালো নির্বাচন করার জন্য ইন্টেরিম সরকার সচেষ্ট।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ফেব্রুয়ারিতে ইলেকশন হবে ধরে নিয়ে প্রার্থী বাছাই, নির্বাচনি ইশতেহার তৈরি, প্রচারণাকৌশল নির্ধারণ ইত্যাদি কাজ গুছিয়ে এনেছে বলে নানা সূত্রে প্রকাশ। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সহসা নির্বাচনের পক্ষপাতী না হলেও তলে তলে ইলেকশনের জন্য তৈরি হচ্ছে। এনসিপি এখনো নিবন্ধন পায়নি। মার্কাও ঠিক হয়নি। তবে দলটি জেলায় জেলায় জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করছে, সভা-সমাবেশ করছে।
এই আবহের মধ্যেও গণতন্ত্র ও ইলেকশনের পথরেখাকে বিঘ্নসংকুল করে তোলার চেষ্টা চলছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহলের অনেকে। গণতন্ত্র ও ইলেকশন ট্রেনের গতি রুদ্ধ করার জন্য মহলবিশেষ কৌশল করছে। গত মঙ্গলবারও জামায়াতে ইসলামীর আমির বলেছেন, জুলাই গণহত্যার বিচারের আগে কোনো নির্বাচন নয়। এর মানে কী? বিচারের সঙ্গে নির্বাচনের কী সম্পর্ক? নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার কোনো কারণ তো নেই। তাহলে বিচারের বিষয়টি নির্বাচনের পূর্বশর্ত করা হচ্ছে কেন?
এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা নাহিদ ইসলাম অপ্রাসঙ্গিকভাবে জাতির পিতা ইস্যু সামনে নিয়ে এসেছেন। পার্টি গঠনের আগে তথা উপদেষ্টা হিসেবে তিনি বলেছিলেন, শেখ মুজিবকে আমরা জাতির পিতা মানি না। সে ক্ষেত্রে তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ আরও অনেকের নাম যুক্ত করে ফাউন্ডিং ফাদারস ঘোষণার দাবি করেছিলেন। কিন্তু এই ইস্যুটি রাজনৈতিক মহলে বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। সংবিধান সংস্কার কমিশন ২০১১ সালে সংবিধানে যুক্ত হওয়া জাতির পিতাসংক্রান্ত ধারাগুলো বিলুপ্ত করার সুপারিশ করলেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। এর মানে হলো সংস্কার প্রশ্নে এটা প্রাসঙ্গিক ইস্যু নয়। এর সঙ্গে জনমানুষের মৌলিক মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। শেখ মুজিবুর রহমান, তার রাজনৈতিক ভূমিকা, তার নামের সঙ্গে যুক্ত উপাধি- সবই ইতিহাসের অংশ। সবই ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। ইতিহাস কোনো মাঠের ফুটবল নয় যে এদিক থেকে কিক করবেন সেদিক গিয়ে পড়বে। ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গায় থাকতে দিতে হবে। সত্যিকারের বিপ্লবী নায়ক ইতিহাস সৃষ্টি করে। আগের অধ্যায়গুলো মুছে দেওয়া তার কাজ নয়। এনসিপির তরুণ নেতৃত্ব তাহলে কেন বিষয়টি সামনে এনে এত ঘাঁটাঘাঁটি করছেন?
প্রসঙ্গত বলা বাঞ্ছনীয় যে ১৯৭২ সালের সংবিধানের কোথাও শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের জাতির পিতা বলা হয়নি। সে সময়ে এ বিষয়ে কোনো গেজেট নোটিফিকেশন হয়েছে বলেও তথ্য পাওয়া যায় না। এবং এমনটি অস্বাভাবিকও কিছু না। মহাত্মা গান্ধী ভারতের জাতির পিতা। কিন্তু সংবিধানে সেটা লিপিবদ্ধ নেই। আমেরিকার সংবিধানেও সে দেশের জাতির পিতা বা পিতাদের নাম নেই। জাতির পিতা আসলে একটি সম্মানসূচক উপাধি। এটা কোনো সাংবিধানিক পদ নয়। সেই সময়ের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শেখ মুজিবকে জাতির পিতা অভিধায় অভিহিত করেছে। সংবাদপত্রে জাতির জনক, মহান নেতা ইত্যাদি বিশেষণ লাগানো হয়েছে। সবই ছিল স্পন্টেনিয়াস। এমনকি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও কাগমারিতে মোহাম্মদ আলী কলেজের ভিত্তি স্থাপন অনুষ্ঠানে মুজিবকে বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির জনক বলে আখ্যায়িত করেন। ২০১১ সালে শেখ হাসিনা নিজের ও পরিবারের স্বার্থে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম জাতির পিতা হিসেবে সংবিধানে যুক্ত করেন। নতুন রাজনৈতিক সরকার এসে সংবিধান সংশোধন করবে। তখন সংসদ যদি মনে করে যে সংবিধানে জাতির পিতাসংক্রান্ত ধারাগুলো থাকার দরকার নেই, তাহলে থাকবে না। তবে এখন এটাকে ইস্যু বানানোর কোনো প্রয়োজন নেই। ওয়াকিবহাল মহলের অনেকে বলছেন, এনসিপি আসলে নানা দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। সেই সঙ্গে ইলেকশন বিলম্বিত করার একটা উদ্দেশ্যও হয়তো রয়েছে।
প্রশ্ন হলো, এনসিপি কেন ইলেকশন বিলম্বিত করতে চাইছে। এখন পর্যন্ত অনিবন্ধিত নবগঠিত দলটির হালফিল খুব যে ভালো অবস্থায় নেই, তা ওপেন সিক্রেট। সাত-আট মাসের মধ্যে ইলেকশন হলে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ছাতাটি মাথার ওপর থেকে সরে গেলে দলের অস্তিত্বের সংকট দেখা দিতে পারে।
দল গঠনের আগে দ্বিতীয় স্বাধীনতা, সেকেন্ড রিপাবলিক, রাষ্ট্র মেরামত, নতুন সংবিধান প্রণয়ন, জাতির পিতা ইস্যু ইত্যাদি ছিল নিজেদের জাহির করার কৌশল। এখন পার্টির ভিতরের কোন্দল, নৈতিক স্খলন, চাঁদাবাজি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিবিধ অনিয়মের অভিযোগে নবগঠিত দলটির টালমাটাল অবস্থা। এমতাবস্থায় জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ঢেরা বাজিয়ে ভয় তাড়াবার কৌশল হিসেবে তারা মুজিববাদ মুর্দাবাদ স্লোগান দিচ্ছে, অকারণে জাতির পিতা ইস্যুটি সামনে নিয়ে আসছে।
বাস্তবিক পক্ষেই অঘোষিত কিংস পার্টি এনসিপি কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়েছে। আলোচিত নেত্রী উমামা ফাতেমা দলটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন তো করেছেনই সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে লাইভে এসে তিনি অভিযোগ করেন, জুলাই আন্দোলনকে মানি মেকিং মেশিনে পরিণত করা হয়েছে। দলের ভিতরের বিশৃঙ্খলা, স্বেচ্ছাচারিতার নানা দিকও তিনি তুলে ধরেন। উমামার বক্তব্য যে অমূলক ছিল না, হাতেনাতে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে গুলশানে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপির বাসায় একদল সমন্বয়কের চাঁদাবাজির ঘটনায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি বাদে সব কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, সারা দেশে সমন্বয়কদের অনেকেই চাঁদাবাজি ও দখলবাজি করছে। কেন্দ্র ঠিক রেখে সব ভেঙে দেওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমে নেটিজেনদের কেউ কেউ বলছেন, চাঁদাবাজির মূল কেন্দ্র অক্ষত রেখে সারা দেশের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। এটা হাস্যকর। গুলশানে যারা ধরা পড়েছে, তাদের কেউ কেউ কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে যুক্ত। এদিকে এনসিপির আরেক নেত্রী নীলা ইসরাফিল ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এনসিপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। তিনি দলের নেতাদের উদ্দেশে লেখেন, ‘আপনারা কি দল করেন নাকি ক্ষমতা আর নারীকে ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার কারখানা চালান?’ উমামা ও নীলার বক্তব্য থেকেই বুঝতে পারা যায়, নবীন এই দলটির ভিতরে ক্লেদ ও ক্লিন্নতা জমেছে কতখানি!
অন্তর্বর্তী সরকারের দুজন উপদেষ্টা রয়েছেন; যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই দুজনের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ করা হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যাকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, সেই মাহফুজ আলম সম্প্রতি ফেসবুকে একটি বিমূর্ত স্ট্যাটাস দেন, যেখানে একটি নতুন দলের মহারথীদের তীব্র ভাষায় কটাক্ষ করা হয়েছে । পরে অবশ্য তিনি স্ট্যাটাসটি এডিট করে, ‘নতুন দলের জায়গায়’ ‘বিভিন্ন দল’-এর মহারথী লিখেছেন। ততক্ষণে যে ঢোল বাজার, তা বেজে গেছে। এতে বোঝা যায়, নতুন দলটি অল্প বয়সে ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। কিংস পার্টি হয়েও, পুলিশ প্রটেকশন নিয়েও এনসিপি জোর কদমে এগোতে পারছে না। দিন দিন তাদের জনপ্রিয়তার পারদও নামছে।
গত বছর এই সময়ে জুলাইয়ের তরুণ নেতৃত্ব আমাদের আপ্লুত ও আন্দোলিত করেছিল। দল-মতনির্বিশেষে এমনকি আওয়ামী লীগের নীরব সমর্থকদের বড় একটা অংশ এই তরুণদের সঙ্গে আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। যারা রাজপথে নামতে পারেননি তারা সামাজিক মাধ্যমে লিখে নৈতিক সমর্থন জুগিয়েছেন। মা-বোন-পিতা, শিশুসন্তানও রাজপথে নেমেছিলেন। শেখ হাসিনার পতনের পর কিশোর ও কিশোরীদের অনেকেই স্বেচ্ছায় নিজের মহল্লায় পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নেমে পড়েছিল। কেউ ডাক দেওয়ার আগেই তারা ট্রাফিক সামলাতে নেমেছিলেন। পরে সমন্বয়করা এলো। আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম এই ভেবে, আমাদের জেন-জি তথা নতুন জেনারেশন ঘুণে ধরা পুরোনো সমাজের আপনপাতে ঝুল টানার ধ্যানধারণা এবার ঠিকই বদলে দেবে। দেয়ালে জেন-জিদের কেউ কেউ লিখেছে, ‘সবার আগে নিজেকে সংস্কার করি।’ এই কথা তারা আন্দোলন চলাকালেই লিখেছে। কিন্তু নেতৃস্থানীয় জেন-জিরা দেয়ালের সেই লিখন পড়লেন না, তারা চাইলেন মসনদের ভাগ। সেটা তারা বাগিয়েও নিলেন। আমরা চাইলাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা হবেন গণতন্ত্রের ভ্যানগার্ড। কিন্তু হলেন তারা ক্ষমতার ভাগীদার। পোহালে শর্বরী তারা হয়ে গেলেন রাজনীতির মঞ্চ ও নেপথ্যের কুশীলব। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।
তবু রাজনীতি কিংবা কালযাত্রায় শেষ বলে কিছু নেই। এখনো বদলাবার সময় আছে। তারুণ্যের শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব নয়। ইতিহাস রিসেট করার দরকার নেই, নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করুন। নির্মাণের ইতিহাস, গণতন্ত্রের বিজয়ের ইতিহাস। একটা কথা বলি, তথাকথিত সুশীল ও এনজিও চিন্তাবিদদের পরামর্শে ইতিহাস বদলে দেওয়ার জন্য সংস্কার সংস্কার করে গত এক বছরে যে বিপুল অর্থ ও শক্তির ক্ষয় করা হয়েছে তার কিয়দংশ সামাজিক ধ্যানধারণার সংস্কার, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ও নিজের পাতে ঝুল টানা সংস্কৃতি বদলের কাজে ব্যবহার করা হলে এক বছরের মধ্যে দেশটি হয়ে উঠতে পারত সত্যিকারের সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। আর এটাই ছিল সময়ের দাবি। কিন্তু কালের যাত্রার ধ্বনি কেউ শুনতে পেল না। নিদেনপক্ষে পাতে ঝুল টানার নিকৃষ্ট কালচারটিও পরিহার করা গেল না।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক