১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা বিপথে পরিচালিত হয়েছিলেন। অস্ত্র এবং ক্ষমতা পেয়ে তারা দিশাহারা হয়ে যান। তাদের দেওয়া হয়নি সঠিক নির্দেশনা। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে তারা হতাশ হতে থাকেন। এরপর হয়ে ওঠেন আত্মবিনাশী। বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই, ডাকাতি এবং চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছিল তাদের বিরুদ্ধে। সাধারণ মানুষ সে সময় এসব বীর তরুণ মুক্তিযোদ্ধার ওপর বিরক্ত হয়েছিল, হতাশা প্রকাশ করেছিল। তরুণ সমাজের একটি অংশ নিজেদের অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছিল। দেশজুড়ে তাদের ত্রাসে জনমনে নতুন আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময় গুণী নির্মাতা খান আতাউর রহমান একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন বিভ্রান্ত তরুণদের ওপর। সিনেমাটির নাম ‘আবার তোরা মানুষ হ’। সে সময়কার প্রেক্ষাপটে এ ছবিটি সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। যে ছবিতে এ রকম বিপথগামী কিছু তরুণকে আবার সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য একজন শিক্ষকের প্রচেষ্টা দেখানো হয়েছিল। আজ বাংলাদেশে চারপাশে তারুণ্যের বিভ্রান্তি দেখে সে সিনেমাটির কথা নতুন করে মনে হলো।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা এসেছে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। দীর্ঘ ৩৬ দিনের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে তরুণরা দেশ ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচারমুক্ত করেন। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের দরজা খুলে দেন। নতুন বাংলাদেশ নিয়ে এ দেশের জনগণের ব্যাপক আকাক্সক্ষা এবং প্রত্যাশা তৈরি হয়। তরুণরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। দেশের জনগণকে মুক্ত করেছেন। কিন্তু গত এক বছরে এ দেশের প্রত্যাশার ফানুস যেন চুপসে গেছে। এর অন্যতম কারণ, জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কারও কারও অনভিপ্রেত কর্মকা । পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায় আন্দোলনে ভূমিকা রাখা তরুণদের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি। তাদের মধ্যে একটা বেপরোয়া মনোভাব জনগণকে আতঙ্কিত করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে জুলাই আন্দোলনে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ উঠছে। চাঁদাবাজি, কমিশন বাণিজ্য এবং নানা রকম অনৈতিক কর্মকাে জড়িয়ে পড়ার কারণে তাদের নিয়ে জনগণ ক্রমে হতাশ হচ্ছে, বিভ্রান্ত হচ্ছে।
সম্প্রতি সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে গুলশানে চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আবদুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান ওরফে রিয়াদ। রিয়াদের ঘটনাটি প্রথম না। গত এক বছরে এ রকম অনেক ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো সমাজমাধ্যমে ঝড় তুলেছে। এ জুলাই যোদ্ধাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে নতুন করে। এসব বন্ধে কেন্দ্রীয় ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সব কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে।
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। দায়িত্ব গ্রহণের পর নতুন সরকারের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে দুজনকে উপদেষ্টা করা হয়। পরে তিনজন ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করলে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং মাহফুজ আলম উপদেষ্টা হিসেবে এখনো দায়িত্ব পালন করছেন। এ দুই উপদেষ্টাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে নানা বিতর্ক। সর্বশেষ উদাহরণ হলো মুরাদনগরের সহিংসতা।
উপদেষ্টাদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রথম বিতর্কের সূত্রপাত হয়। আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সহকারী একান্ত সচিব মো. মোয়াজ্জেম হোসেন এবং উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ছাত্র প্রতিনিধি তুহিন ফারাবীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তাদের বিরুদ্ধে ওঠা শতকোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শুধু তাই নয়, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক সাবেক তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের সাবেক পিএস আতিক মোর্শেদের বিরুদ্ধেও মোবাইল ব্যাংকিং নগদের দেড় শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগ নিয়েও এখন তদন্ত হচ্ছে। এনসিপির অন্যতম প্রভাবশালী নেতা এবং দলের যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। পাঠ্যপুস্তকের টেন্ডারে প্রভাব বিস্তার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। দেশজুড়ে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয়দের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠছে। চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী নেতার বিরুদ্ধে ২ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করার অভিযোগ উঠেছে। চাঁদা না পেয়ে মব তৈরি করে চট্টগ্রামে পেট্রো কর্মচারী জামায়াত নেতা নওশেদ জামালকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মহানগর কমিটির সদস্যসচিব নিজাম উদ্দিনের পদ সাময়িক স্থগিত করা হয়। গাজীপুরে চাঁদা দাবির অভিযোগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাসহ ১২ অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গাজীপুর জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক আকাশ খান, ইমতিয়াজ শুভ, মোক্তার হোসেন, ইফতেখার শুভ, মো. আসিফ, পিয়াস ঘোষ প্রিন্স চাঁদাবাজি করেছেন একজন আওয়ামী লীগ নেতার বাসায়। এরা সবাই জুলাই যোদ্ধা। প্রশ্ন উঠেছে-তাদের কেন এসব অবৈধ কর্মকাে জড়াতে হবে? এ ধরনের অভিযোগগুলো নিয়ে এখন সাধারণ মানুষ শুধু বিরক্ত নয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যারা উদ্যোক্তা তারাও বিব্রত। দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা জুলাই যোদ্ধা পরিচয় দেওয়া এসব শিক্ষার্থীর বেপরোয়া কর্মকাে হতবাক, লজ্জিত। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এসব খবরে তিনি বেদনায় নীল হয়ে যান। তিনি শুধু একা নন, এ ধরনের সংবাদ গোটা বাংলাদেশকেই বেদনার্ত করে। এক বছর আগে তাদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের যে আবেগ আর ভালোবাসা ছিল, এখন তা শূন্যের কোঠায়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে গঠিত হয় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এনসিপির একাধিক নেতার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। সে অভিযোগের কারণে তাদের কার্যক্রম এনসিপি স্থগিত করেছে। কিন্তু এনসিপির বহু কর্মকা ই জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। এমনকি জুলাই আন্দোলনের সহযোদ্ধারাও তাদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র ও সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা জুলাই আন্দোলনকে ‘মানি মেকিং মেশিন’ বানানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এসব পরিণতি দেখে সমাজমাধ্যমে একাধিক পোস্ট দিয়েছেন। তিনি নিজেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো-এ ধরনের ঘটনাগুলো কেন ঘটছে? কেন জুলাই আন্দোলনে যারা সক্রিয় ছিলেন, তারা এখন বিপথে পরিচালিত হচ্ছেন? এর একটি বড় কারণ হলো সঠিক দিকনির্দেশনা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব। সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা ছাড়া এসব তরুণ যে বিভ্রান্ত হবেন, তা বলাই বাহুল্য। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল দ্রুত সব পরিস্থিতি ঠিকঠাক করে একটি নির্বাচনের পথে যাওয়া। নির্বাচিত সরকার জুলাই আন্দোলনের তরুণদের ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা গ্রহণ করবে এবং তাদের রাষ্ট্রের ‘বিবেক’ হিসেবে ব্যবহার করবে, যেন তারা যে কোনো সরকারের ভুলভ্রান্তি বা যে কোনো অসংগতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হতে পারেন। তারা জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, এটাই ছিল সবার প্রত্যাশা। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের পরপরই প্রথম থেকে লক্ষ করা যায়, কিছু কিছু বিভ্রান্ত তরুণ এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের বিত্তশালী হওয়ার চেষ্টা করেন। কারও কারও মধ্যে রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। যাদের ঘরে টিন ছিল না, তারা পাকা দালান দেওয়া শুরু করেন। দৃষ্টিকটুভাবে বিত্তবৈভবের প্রদর্শনী করেন। এরপর যখন এ তরুণরা রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তখন অনেকের মধ্যে ধারণা হতে থাকে যে এ রাজনৈতিক উদ্যোগের পেছনে রয়েছে কোনো লাভজনক অভিপ্রায়। দেশবদলের জন্য নয়, বরং নিজেদের ভাগ্যবদলের জন্যই রাজনৈতিক আয়োজন। এ দলের কিছু কিছু নেতার কর্মকাে তার লক্ষণ সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, জুলাইয়ে যারা আন্দোলন করেছেন, যারা সামনে থেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অকুতোভয় সৈনিকের মতো লড়াই করেছেন তারা আমাদের গর্ব। সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে তারা এটি করেছিলেন দেশপ্রেমের জন্য, ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়। দেশ মুক্ত করার জন্য। কিন্তু তারা যদি ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং লাভের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন এবং নিজেদের ভাগ্য পাল্টে ফেলার জন্য অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করেন; চাঁদাবাজি, কমিশন বাণিজ্য বা বিভিন্ন ধরনের অগ্রহণযোগ্য পন্থায় অর্থ উপার্জন শুরু করেন তাহলে সাধারণ মানুষ সেটাকে ইতিবাচকভাবে নেবে না এবং নিচ্ছেও না। এর ফলে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
অনেকে মনে করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের যেভাবে পথ দেখানো উচিত ছিল, সেভাবে পথ দেখানো হয়নি। বরং ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে কোনো কোনো স্বার্থান্বেষী মহল তাদের ক্ষমতার লড়াইয়ের মাঠে নামিয়েছে। তরুণদের রাজনৈতিক দল গঠন দোষের কিছু নয়, কিন্তু দরকার প্রস্তুতি এবং অধ্যবসায়। তরুণরা এ ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য কতটা প্রস্তুত সে প্রশ্ন রয়ে গেছে। এ তরুণরা যদি বিভ্রান্ত হয়ে যান, বিপথে পরিচালিত হন এবং যেভাবে তাদের বিরুদ্ধে কথাবার্তা হচ্ছে, তা যদি জনতার কণ্ঠস্বর হয়ে যায় তাহলে শেষ পর্যন্ত জুলাই বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। এ দেশের মানুষ খুবই আবেগপ্রবণ। সহজেই একটি ভালো জিনিসের প্রতি যেমন তারা আপ্লুত হয়, তেমন একটি খারাপ ঘটনা তাদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। আর সে কারণেই সবাই প্রত্যাশা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর সেই সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ হলো দেশে দ্রুত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। একটি গণতান্ত্রিক এবং জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা হলে তরুণদের এ বিভ্রান্তি দূর হবে। গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্য দিয়ে তারা বিকশিত হবেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর তরুণরা যেভাবে বিভ্রান্তির চোরাগলিতে আটকা পড়ে একটি প্রজন্ম ধ্বংস হয়েছিল, আমরা চাই না চব্বিশের জুলাই যোদ্ধারাও সেভাবে বিতর্কিত হোন, ধ্বংস হয়ে যান।