আগামী বছরের ২৪ নভেম্বর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। নিঃসন্দেহে এটি একটি সুখবর। স্বাধীনতার সময় বাংলদেশ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে হতদরিদ্র দেশ। সেখান থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দুই শতাধিক দেশের মধ্যে ৩৫তম অর্থনীতি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। প্রতি সাতজনের একজন অর্থাৎ এক কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে প্রতিবেশী দেশে। লাখ লাখ ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের উত্থান গর্ব করার মতো। ভস্ম থেকে রূপকথার ফিনিক্স পাখির মতো উড়াল দেওয়ার সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এ প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্য আয়ের বা উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে আগামী বছরের ২৪ নভেম্বরকে শুভক্ষণ হিসেবে নির্ধারণ করেছে। দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং অর্থনীতিবিদরা রাজনীতি ও অর্থনীতির নাজুক মুহূর্তে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ নিয়ে চিন্তিত। সরকারের মধ্যেও সংশয় কম নয়। তবে আমাদের দারুণ সাহসী প্রধান উপদেষ্টা সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠার পক্ষে। কারণ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে গেলেও গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে পাওয়া যাবে তিন বছর। এ সময়ে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। কিন্তু দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির যে হালহকিকত তাতে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যে সুযোগসুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, তা বন্ধ হলে কী অবস্থা দাঁড়াবে তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে বোদ্ধাজনদের মধ্যে। নিয়ম অনুযায়ী এলডিসি উত্তরণের পর থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে ইউরোপের বাজারের বিদ্যমান শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা। রপ্তানির ক্ষেত্রে গুনতে হবে অতিরিক্ত শুল্ক। যা দেশের রপ্তানি খাতকে আরও চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দেবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বেড়ে যাবে বৈদেশিক ঋণের সুদ। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও বাড়বে চাপ। কমবে বৈদেশিক অনুদান। ফলে দেশের অর্থনীতি বিপাকে পড়তে পারে। অর্থনীতি যেহেতু রাজনীতির প্রাণ সেহেতু নির্বাচনের মাধ্যমে যে নতুন সরকার আসছে তাদের বিপাকে পড়তে হবে। এ অবস্থায় জাতে ওঠার গর্বে বিভোর না থেকে বাস্তবতাকে মনে রেখে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ। কিন্তু আমলা ও সুশীলনির্ভর অন্তর্বর্তী সরকার এ ক্ষেত্রে কতটা তৎপর, তা প্রশ্নের বিষয়। দেশের অর্থনীতি যখন চাঙা করা দরকার, তখন তারা চলছে উল্টো পথে। ইতোমধ্যে
নতুন শিল্প কলকারখানায় গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তাকে আত্মঘাতী বলে অভিহিত করেছেন অনেকে। ১৮ কোটি মানুষের এই দেশে বেকারের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি সরকারের জন্য আশু কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনই এক নাজুক অবস্থায় নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিটে ১০ টাকা বা ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত শিল্প স্থাপনে শিল্পোদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করবে। আমাদের দেশে একসময় নতুন শিল্প উদ্যোক্তাদের ট্যাক্স
হলিডে দেওয়া হতো। বাড়তি সুবিধার বদলে নতুন শিল্পের জন্য গ্যাসের বেশি দাম নির্ধারণ দেশি উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণেও তা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। নতুন শিল্পের জন্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের তীব্র আপত্তির পরও নতুন শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। ফলে ক্যাপটিভ অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ৩১.৫০ টাকার বদলে হবে ৪২ টাকা। শিল্প খাতে বর্তমানে ৩০ টাকার বদলে হবে ৪০ টাকা। নতুন শিল্পের পাশাপাশি এখন যারা অনুমোদিত লোডের বেশি গ্যাস ব্যবহার করছেন, সেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানকেও ৩০ টাকার পরিবর্তে ৪০ টাকা দরে বিল দিতে হবে। ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা ব্যবসাবাণিজ্যের ওপর গ্যাসের দাম বাড়ানোর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। নতুন বিনিয়োগেও অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। নতুন ও পুরোনো বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তে মনে হচ্ছে দেশে আর নতুন কোনো শিল্প গড়ে উঠুক বা নতুন করে বিনিয়োগ আসুক তা তারা চায় না। শিল্পোদ্যক্তাদের অভিযোগ, গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়বে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য মূল্যবৃদ্ধি বিড়ম্বনা ডেকে আনবে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যবসার পরিবেশে অনিশ্চয়তা বাসা বেঁধেছে। ব্যাংকঋণের উচ্চহারের প্রভাবে গত কয়েক মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে। দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে যখন ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ দরকার তখন নতুন শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো শিল্পায়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। দাম না বাড়িয়ে গ্যাস বিপণনে দুর্নীতি রোধ করার দিকে সরকার নজর দিলে সেটিই হতো উত্তম। দেশের ব্যবসাবাণিজ্যে আস্থার পরিবেশ গড়ে তুলতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিকল্প নেই। নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারই কেবল এ ধরনের নিশ্চয়তা দিতে পারে। আমাদের সবাইকে সে পথেই হাঁটতে হবে।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ব্যবসায়ী দল