এক সময়ের কথা, ঘন অরণ্যে ঘেরা এক রাজ্যে আকাশচুম্বী পাইন গাছের মাথায় জমে থাকত সাদা বরফের চাদর। রাজপ্রাসাদের চূড়ায় জ্বলত একটি জাদুকরী মুকুট, রাজকুমার আলেকজান্ডারের মাথায় যার আলোয় ফুটে উঠত ঋতুর রং। কিন্তু এক রাতেই সব বদলে গেল! এক দানবীয় ড্রাগন, যার চোখ জ্বলজ্বল করত লাল আগুনের মতো, মুকুটটি ছিনিয়ে নিয়ে গেল গভীর গুহায়। রাজ্য ধীরে ধীরে জমে যেতে লাগল বরফে, গাছের পাতা ঝরে পড়ল, নদী জমে হলো বরফের সড়ক। রাজকুমারী এলিসা, যার চুল সোনালি রোদের মতো উজ্জ্বল, শপথ নিল, ‘আমি মুকুট ফিরিয়ে আনব, নইলে আমার ভাইয়ের প্রাণ যাবে!’ পথ দেখাল এক জ্ঞানী কাক, কালো পালকে মোড়া, যে কথা বলতে পারত মানুষের ভাষায়। কাক বলল, ‘ড্রাগনের গুহায় যাওয়ার পথে তিনটা পরীক্ষা পার হতে হবে। হার মানলে তুমি চিরতরে পাথর হয়ে যাবে!’
বিষাক্ত নদীর ধারে দাঁড়িয়ে এলিসা। কালো জল গর্জে উঠল, ‘পার হতে চাইলে দাও তোমার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস!’ কাক ফিসফিস করল, ‘নদীর তলায় আছে জাদুর স্পিন্ডেল। এটি ছুঁলেই জল সাফ হবে, কিন্তু স্পিন্ডেল ধারণ করবে তোমার যৌবন!’ এলিসা নির্দ্বিধায় হাত ডুবাল জলে। স্পিন্ডেল ছুঁতেই জল সাফ হয়ে গেল, কিন্তু তার হাত কুঁচকে গেল বৃদ্ধার মতো! গুহার মুখে এক বিশাল সাপ, যার চোখে ঘূর্ণির ছাপ। সাপ হেসে বলল, ‘আমার আসল নাম বলতে পারলে পথ ছেড়ে দেব। নাম ভুল হলে গলাটা চেপে ধরব!’ এলিসা ভাবল, ‘ড্রাগনের নাম তো “ইগনিস’ কিন্তু সাপের নাম?’ হঠাৎ কাক ডাকল, ‘সাপের গলায় দেখো!’ সাপের গলায় ঝুলছিল একটি পেনডেন্ট, তাতে লেখা ‘মেলুসিনা’। এলিসা চিৎকার করল, ‘তোমার নাম মেলুসিনা!’ সাপ গর্জে উঠল, ‘কাকটা সাহায্য করল? ছেড়ে দিলাম এবার!’ গুহার গভীরে ড্রাগন ‘ইগনিস’ ঘুমিয়ে, মুকুট জ্বলজ্বল করছে তার মাথায়। কিন্তু মুকুটের চারদিকে জ্বলছিল আগুনের বলয়। কাক বলল, ‘এই আগুন নেভাতে লাগবে তোমার সোনালি চুলের একটি গুচ্ছ। চুল পোড়ালেই মুকুট মুক্ত হবে!’ এলিসার চোখে পানি এলেও সে কাঁচি চালাল চুলে। সোনালি গুচ্ছ আগুনে ছুড়ে দিতেই মুকুটের জাদু ভাঙল, ড্রাগন গর্জে উঠল, ‘কে আমার ঘুম ভাঙাল?’ ড্রাগন এলিসাকে গ্রাস করতে উদ্যত হলেই মুকুট থেকে ঝলসে উঠল এক তীব্র আলো। আলোয় ড্রাগনের শরীর শক্ত পাথরে পরিণত হলো! এলিসা মুকুটটি নিয়ে ছুটল রাজপ্রাসাদের দিকে। পথে তার সাদা হয়ে যাওয়া চুল উড়ছিল বাতাসে। রাজকুমার আলেকজান্ডারের মাথায় মুকুট পরাতেই রাজ্যে ফিরে এলো বসন্ত! গাছের ডালে ফুটল কুঁড়ি, নদীতে গলল বরফ। কিন্তু এলিসার চুল আর কখনো সোনালি হলো না। তবুও রাজ্যের মানুষ বলত, ‘সে আমাদের স্বর্ণহৃদয় রাজকন্যা, যে তার সোনালি চুল দিয়ে দিল, পেল না ফিরে!’ রাজকুমারী এলিসার সাদা চুলের রূপকথা পুরো রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু কেউ জানে না, পাথর হয়ে যাওয়া ড্রাগনের দেহ থেকে সেই রাতেই বেরিয়ে এসেছে এক যুবক, নীল চোখ, আগুনের মতো লাল চুল, আর গলায় জ্বলজ্বল করা একটি পেনডেন্ট। সে হেঁটেছে অরণ্যের গভীরে, যেন কোনো স্মৃতি খুঁজছে।
এলিসা এক দিন বনের পাশে বসে ছিল। হঠাৎ দেখল, এক অচেনা যুবক নদীর পানি পান করছে। তার গলার পেনডেন্টে লেখা ‘ইগনিস’। এলিসার চোখ ছানাবড়া! ‘ড্রাগনের পেনডেন্ট! তুমি! তুমিই সেই?’ যুবক ঘুরে তাকাল। চোখে বিভ্রান্তি, ‘আমি কে? আমার নামও জানি না। শুধু এই পেনডেন্ট আর তোমার মুখটা মনে পড়ে।’ এলিসা বুঝল, অভিশাপ ভাঙলেও রাজকুমারের স্মৃতি মিশে গেছে ধোঁয়ায়। মধ্যরাতে কাক এসে ডাকল জানালায়, ইগনিসের স্মৃতি ফেরাতে চাও? তাহলে যেতে হবে ‘অন্ধকারের মরুভূমি’তে, যেখানে ঘুমিয়ে আছে ‘অনন্ত সূর্যের ফুল’। কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে পারবে কেবল তারা, যারা একে অপরের শত্রু ছিল! এলিসা আর ইগনিস মুখোমুখি দাঁড়াল। ইগনিস বলল, ‘তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো? আমি তো এক দিন তোমার শত্রু ছিলাম।’
এলিসা হেসে বলল, ‘আজ তুমি আমার অচেনা বন্ধু। চলো!’
ভূতুড়ে মরুভূমি, বালির নিচে লুকিয়ে থাকা ‘কালোচোখ সাপ’ তাদের পথ আটকাল। সাপের শর্ত; ‘গান গেয়ে আমাকে কাঁদাতে পারলে পথ ছাড়ব!’ ইগনিস গাইল প্রাচীন এক গান, যে গান শুনে সাপের চোখে জল এলো, ‘এই গান আমার মা গাইত!’ প্রকাশ করে। এলিসা আর ইগনিসকে হেঁটে যেতে হলো পানির ওপর। ইগনিসের প্রতিবিম্ব দেখাল অতীত; সে কীভাবে এক দুষ্ট জাদুকরের শিকার হয়ে ড্রাগনে পরিণত হয়েছিল! বিশালাকার ক্যাকটাসের মাঝে, যাকে ঘিরে থাকত আগুনের প্রজাপতি। এলিসা বলল, ‘ফুল ছুঁতে গেলে প্রজাপতিরা পুড়িয়ে দেবে!’ ইগনিস তখন নিজের হাত বাড়াল, প্রজাপতিরা তার লাল চুল স্পর্শ করে শান্ত হয়ে গেল! ফুলটি তুলতেই মাটি কেঁপে উঠল! দুষ্ট জাদুকর ‘মালগোর’ আবির্ভূত হলো যে, ইগনিসকে শাপ দিয়েছিল। সে গর্জে উঠল, ‘ফুলটি দাও! না হলে এই মরুভূমিই হবে তোমাদের কবর!’ ইগনিস আর এলিসা মিলে ফুলের একটি পাপড়ি ছিঁড়ে ফেলল। পাপড়ি থেকে বিচ্ছুরিত হলো তীব্র আলো, যা মালগোরের দেহকে বালিতে পরিণত করল!
ইগনিস ফুলের রস পান করতেই তার স্মৃতি ফিরে এলো! সে জানাল, ‘আমি আসলে প্রতিবেশী রাজ্যের রাজকুমার! মালগোর আমার রাজ্য ধ্বংস করে আমাকে সাপ দিয়েছিল।’ এলিসা হেসে বলল, ‘তোমার রাজ্য এখনো আছে। চলো, সেখানে ফিরে যাই!’
ইগনিসের রাজ্যে ফিরে তারা দেখল, সবাই ভেবেছিল ইগনিস মারা গেছে। রাজ্য এখন শাসন করছে মালগোরের অনুগত এক দানব! ইগনিস আর এলিসা মিলে দানবকে পরাজিত করে রাজ্য মুক্ত করল। ইগনিস বলল, ‘এলিসা, তুমিই এখন এই রাজ্যের রানি হওয়ার যোগ্য।’ কিন্তু এলিসা মাথা নেড়ে বলল, ‘না, আমার রাজ্য তো ওই পাইনবনের নিচে! কিন্তু আমি চাই আমাদের রাজ্যগুলো যেন বন্ধুত্বের সেতু হয়ে থাকে।’ জ্ঞানী কাকের আসল রহস্য উন্মোচনের সময় এসেছে! এলিসা আর ইগনিস ফিরে এলো তার নিজ রাজ্যে, কিন্তু এক রাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখল এলিসা-এক যুবক, যার চোখ কাকের মতো কালো, তাকে ডাকছে অরণ্যের গভীর থেকে!
পরের দিন সকালে, রাজপ্রাসাদের দরজায় হাজির এক রহস্যময় যুবক। তার গায়ে কালো পালকের চাদর, চোখে অগাধ দুঃখ। সে বলল, ‘আমি লিওনিড, শত বছর আগে অভিশপ্ত হয়েছিলাম কাক হয়ে, কারণ আমি আমার প্রিয়াকে হারিয়েছিলাম স্বার্থের জন্য। তোমার ত্যাগ দেখে আমার অভিশাপ ভাঙার সময় এসেছে। কিন্তু তার জন্য চাই, তোমার হৃদয়ের এক ফোঁটা অশ্রু!’ এলিসা জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন?’
লিওনিড বলল, ‘তোমার অশ্রুতেই লুকিয়ে আছে সেই জাদু, যা আমাকে মানব করে তুলবে। কিন্তু সতর্ক থেকো। এটা তোমাকে কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ করে দেবে!’ এলিসা চিন্তা করল না। সে লিওনিডের হাত ধরে বলল, ‘তুমি আমাকে সাহায্য করেছ, এখন আমার পালা।’ তার চোখ থেকে একটু অশ্রু পড়তেই লিওনিডের পালকগুলো ঝরে পড়ল, আর সে হয়ে গেল এক সুন্দর যুবক! কিন্তু এলিসার চোখ ঢেকে গেল ধোঁয়ায় সে অন্ধ হয়ে গেল! ইগনিস ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, ‘এটা কী করলে তুমি? ওকে অন্ধ করেছ!’ লিওনিড কেঁদে বলল, ‘আমি জানতাম না! অভিশাপের নিয়ম এটাই কিন্তু আমার শক্তি দিয়ে ওকে ফিরিয়ে দেব!’
লিওনিড এলিসাকে নিয়ে গেল ‘চন্দ্রকূপ’ নামের এক গুহায়, যেখানে আছে ‘চোখের জল’ নামের এক জাদুর ঝরনা। কিন্তু গুহার রক্ষী হলো ‘অর্ধেক মানবী, অর্ধেক সাপ’ এক দানবী! দানবী গর্জে উঠল, ‘ঝরনার জল পেতে হলে আমাকে দাও সেই ব্যক্তির হৃদয়, যে তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে!’ ইগনিস এগিয়ে এসে বলল, ‘নাও আমার হৃদয়।’ কিন্তু এলিসা চিৎকার করে বলল, ‘না! আমি চাই না কারো ত্যাগ!’
তখন লিওনিড নিজের বুক চাপড়ে বলল, ‘নাও আমার হৃদয়। কারণ আজ বুঝেছি, ভালোবাসা মানে স্বার্থহীন ত্যাগ।’ দানবী হাসল, ‘তোমাদের তিনজনের ভালোবাসাই সত্যি। যাও, জল নাও!’ ঝরনার জল এলিসার চোখে পড়তেই তার দৃষ্টি ফিরে এলো! কিন্তু তখনই গুহা ধসে পড়তে শুরু করল। লিওনিড বলল, ‘এখানেই আমার শেষ যাত্রা। আমিই গুহা ধরে রাখব, তোমরা পালাও!’ ইগনিস আর এলিসা বাইরে বেরোলো। পিছনে লিওনিডের শেষ কথা ভেসে এলো, ‘ভালোবাসা কখনো মরে না। আমি এখন স্বাধীন!’ রাজ্যে ফিরে এলিসা আর ইগনিস দেখল-দুই রাজ্যের মাঝে গজিয়ে উঠেছে একটি সোনালি সেতু! লিওনিডের বলিদানের পর থেকে মানুষের হৃদয়ে শত্রুতা হারিয়ে গেছে। এলিসা বলল, এখন থেকে আমাদের রাজ্যের নাম হবে ‘স্বর্ণসেতুর রাজ্য’।
ইগনিস হাসল, আর আমরা হবো চিরকালের জন্য এই সেতুর রক্ষী।