২১২৫ সাল।
পৃথিবীতে তখন আর কোনো বই নেই। কাগজ, কলম, পেনসিল- সবকিছু হারিয়ে গেছে বহু বছর আগে। শিশুদের লেখাপড়া হয় শুধু স্ক্রিনে, চোখে পরা ‘এডুক-ভাইজর’ নামক এক যন্ত্রের মাধ্যমে। এই যন্ত্র মাথায় দিলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সবকিছু- গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস। পড়া, লেখা, প্রশ্ন, উত্তর- সবকিছু স্ক্রিনে। প্রথমে ব্যাপারটা খুব আনন্দের ছিল। পেনসিলের কষ্ট নেই, ভুলের ভয় নেই। কিন্তু আস্তে আস্তে দেখা দিলো এক ভয়ংকর সত্য। এগারো বছর বয়সি নিরা হঠাৎ স্কুলে যেতে অনীহা দেখাল। চোখে সবসময় পানি, আলোতে তাকাতে কষ্ট। বন্ধুরা চিন্তিত মুখে বলল, ‘তোর চোখে কী হয়েছে?’ নিরা চুপচাপ বসে থাকে। পরে জানা গেল, ওর দৃষ্টিশক্তি খুব দুর্বল হয়ে গেছে। শুধু ও না- পুরো শহরের শিশুদের চোখে সমস্যা।
চিকিৎসকরা বললেন, ‘এই যন্ত্রে শিশুর চোখ দিনের পর দিন তাকিয়ে থাকে তীব্র আলোয়। বিশ্রাম নেই, পাতা নেই, শুধু স্ক্রিন... আর এতে করেই চোখ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।’
প্রশাসন প্রথমে তা অস্বীকার করল। কিন্তু যত দিন গেল, শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ততই খারাপ হতে থাকল। হাসপাতালের বারান্দা, চোখের ক্লিনিক, স্কুলের ছাদ- সবখানেই কান্নার শব্দ। ছোট ছোট বাচ্চারা আলোতে তাকাতে পারে না। শুধু চোখে ব্যথা আর ঝাপসা পৃথিবী। সেদিন শহরের আলো থমকে গিয়েছিল। এক বিজ্ঞান সভায় একজন বৃদ্ধ গবেষক বললেন, ‘একসময় বই ছিল ঘরে ঘরে। মানুষ পড়ত, শিখত, ভাবত। পরে প্রযুক্তি এলো- সব শেখা হলো যন্ত্রনির্ভর। মানুষ বই ছুঁয়েও দেখত না। একে একে ছাপাখানা বন্ধ হলো, বই হারিয়ে গেল।’
কতদিন বই ছাড়াই চলবে? চোখ তো যন্ত্র নয়! বইতে চোখ স্বস্তি পায়। বই কেবল পড়ার জিনিস নয়- বই একটা ছায়া, একটা বিশ্রাম।
অথচ তখনকার শিশুরা জানেই না বই কাকে বলে। নিরা একদিন প্রশ্ন করল, ‘বই মানে কি একটা স্ক্রিন? কিন্তু আলোর কম ভার্সন?’ এক গবেষক মৃদু হেসে বলেন, ‘বই মানে পাতার ঘ্রাণ, শব্দের স্পর্শ আর কল্পনার জানালা।’
এই ঘটনার পর মানুষ আবার বইয়ের কথা ভাবতে শুরু করল। পুরোনো লাইব্রেরির ধ্বংসস্তূপ ঘেঁটে, জাদুঘরের কাচ ভেঙে কিছু বই উদ্ধার করা গেল। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে নতুনভাবে কাগজ তৈরি করলেন- পরিবেশবান্ধব, চোখে আরামদায়ক। তারা বললেন, ‘আমরা নতুন বই ছাপব। আলোহীন চোখের জন্য আলোকময় শব্দ চাই।’ একদিন ‘নিরা’ নামেই প্রকাশ পেল প্রথম বই। নিরার চোখের গল্প আর বইয়ের ফিরে আসা। শিশুরা নতুন বই হাতে নিয়ে পাতায় আঙুল বুলিয়ে বলল, ‘এটা তো স্ক্রিন না, তবু সব দেখতে পাই!’
ধীরে ধীরে এডুক-ভাইজর বন্ধ হয়ে গেল। স্কুলে ফিরে এলো খাতা, কলম, লাইব্রেরি। শিশুরা বলল, ‘আমরা এখন বুঝতে পেরেছি বই শুধু শেখায় না, বই আমাদের দৃষ্টিশক্তি বাঁচায়।’
নিরা এখন বড়ো হয়েছে। নিরার চোখে আলো ফিরেছে। ও বই লেখে, আঁকে, গল্প শোনায়। আর শহরের এক বিশাল লাইব্রেরির গেটে লেখা আছে- ‘বই মানে আলো বই মানে আশ্রয়।’