অপরিকল্পিত নগরায়ণের থাবা পড়েছে চট্টগ্রামের জলাধারগুলোতে। অপরিকল্পিত শহুরে বিস্তার, আবাসিক এবং বাণিজ্যিক স্থানের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে গত তিন দশকে বিলীন হয়েছে প্রাকৃতিক জলাধার অন্তত কয়েক হাজার পুকুর, দিঘি ও ছোট হ্রদ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা; জলাধার হ্রাসের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে পরিবেশে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জের স্থানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)-এর প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস বলেন, ‘জলাধার ভরাট করে যাতে কেউ ভবন নির্মাণ করতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর হয়েছে সিডিএ। কেউ বহুতল ভবনের প্ল্যানের জন্য আবেদন করলে ওই ভূমিতে অতীতে জলাধার ছিল কি না তা ভালোভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিরও সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি সময়ে এ ধরনের বেশ কিছু আবেদন এসেছে আমাদের কাছে। যা বাতিল করা হয়েছে।’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. বায়েজিদ মাহমুদ খান সতর্ক করে বলেন, ‘জলাধার হ্রাস হওয়ার পরিবেশগত বিপর্যয় ইতোমধ্যে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। আমরা ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জের স্থানগুলো হারাচ্ছি। জলরোধী কংক্রিট মাটির নিচে দেবে যাওয়া এমনকি মরুকরণের ঝুঁকি তৈরি করছে।’ সিডিএ- ২০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য সমীক্ষা শুরু করে কয়েক বছর আগে। চলমান এ সমীক্ষায় জলাধার হ্রাসের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরে জলাধার রয়েছে ২ হাজার ৯২টি। অথচ ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সালের সরকারি জরিপে রেকর্ড করা জলাধার ছিল ৪ হাজার ৩৩২টি। চার দশকে চট্টগ্রাম নগরে হারিয়ে গেছে অর্ধেকেরও বেশি জলাধার। শহরের সীমানার বাইরেও জলাধার হ্রাসের চিত্রটি আরও হতাশাজনক। চট্টগ্রাম জেলার ১৫টি উপজেলায় মাত্র গত তিন বছরে ৪ হাজার ৫১১টি জলাধার বিলীন হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী- ২০২২ সালে ৪৮ হাজার ২৪৫টি জলাধার ছিল। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এ সংখ্যা কমে ৪৩ হাজার ৭৩৪টিতে দাঁড়িয়েছে।
জানা যায়, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ভূমির মূল্যবৃদ্ধি, নতুন আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা নির্মাণ, পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতার অভাবসহ নানান দুর্নীতিই হারিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম নগর এবং জেলার একের পর এক জলাধার। ভয়ানক থাবায় পড়ে গত কয়েক দশকে হারিয়ে গেছে চট্টগ্রামের চেনাজানা নামকরা অনেক পুকুর, দিঘি এবং হ্রদ। এরকমই একটি জলাধার নগরের নন্দনকানন এলাকার রথের পুকুর। ঐতিহ্যবাহী পুকুরটা এখন হারিয়ে গেছে বহুতল ভবনের নিচে। তেমনি হারিয়ে গেছে আন্দরকিল্লার রাজা পুকুর, দেওয়ানবাজারের দেওয়ানজি পুকুর, চান্দগাঁওয়ের মৌলভী পুকুর, ফিরিঙ্গীবাজারের ধাম্মো পুকুর, বহদ্দারহাটের মাইল্যার পুকুর, চকবাজারের কমলদহ দিঘি, কাট্টলীর সিডিএ এলাকার পদ্মপুকুর ও উত্তর কাট্টলীর চৌধুরীর দিঘি, ষোলোশহর হামজারবাগ এলাকার হামজা খাঁ দিঘি, খতিবের হাট পুকুরসহ শত শত পুকুর। জলাধার হ্রাসের প্রভাব প্রকৃতিতে পড়তে শুরু করেছে এরই মধ্যে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে যাওয়ায় বঙ্গোপসাগরের লবণাক্ত পানি মাটির গভীরে প্রবেশ করছে। কিছু এলাকায় ৯০০ মিটার গভীর নলকূপ থেকেও লবণাক্ত পানি উঠে আসছে। নেমে যাচ্ছে ভুগর্ভস্থ পানির স্তর। ২০১১ সালে আগ্রাবাদে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ২৪১ ফুট। ২০২৪ সালে যা নেমে হয়েছে ৩৪০ ফুট।