বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণ সমস্যা দিনদিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। আর দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। বিশেষত শহরাঞ্চলে বায়ুদূষণ, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অক্সিজেন সংকট উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বছরের অধিকাংশ সময় বায়ুদূষণের শীর্ষে থাকে রাজধানী ঢাকা। এতে হুমকিতে জনস্বাস্থ্য। বাড়ছে রোগবালাই। স্বাস্থ্যগত সমস্যায় কমছে উৎপাদনশীলতা, যা জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এমন প্রেক্ষাপটে পরিবেশ রক্ষায় বাঁশকে কার্যকর ‘সবুজ সমাধান’ হিসেবে ভাবছেন গবেষকরা। বাঁশের সর্বোচ্চ অক্সিজেন উৎপাদন, কার্বন শোষণ ও দ্রুত বর্ধনশীল বৈশিষ্ট্য একে অন্যতম পরিবেশবান্ধব একটি উদ্ভিদে পরিণত করেছে।
পরিবেশবিদদের মতে, একটি পূর্ণবয়স্ক বাঁশ বছরে প্রায় ৩৫০ কেজি পর্যন্ত কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতে পারে, যা তুলনামূলকভাবে অধিকাংশ গাছের চেয়ে অনেক বেশি। একই সঙ্গে এটি ২৭০ থেকে ৩০০ কেজি অক্সিজেন নির্গত করে, যা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের এক বছরের শ্বাস-প্রশ্বাসের চাহিদা পূরণে যথেষ্ট। সাধারণ বনের চেয়ে বাঁশবন ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেশি অক্সিজেন নির্গমন করে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং আন্তর্জাতিক বাঁশ ও বেত সংস্থা (আইএনবিএআর)-এর তথ্যমতে বাঁশের দ্রুত বর্ধনশীলতা, ঘন পাতা ও মজবুত শিকড় ব্যবস্থা এটিকে একটি কার্যকর কার্বন ক্যাপচারিং উদ্ভিদে পরিণত করেছে। প্রতি হেক্টর বাঁশবন বছরে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ টন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, জাতভেদে কিছু বাঁশ এক হেক্টরে বছরে ৬০ টন পর্যন্ত কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতে পারে, যা অন্য যে কোনো গাছের চেয়ে বেশি। বাঁশ দিনে ৩ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এটি পাতার মাধ্যমে অনেক বেশি সালোকসংশ্লেষণ করে। অর্থাৎ, খাদ্য তৈরি করতে বাতাস থেকে প্রচুর কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে ও অক্সিজেন নির্গমন করে। মাটির নিচে বাঁশের রাইজোম সিস্টেম কার্বন ধরে রাখে অনেক বছর। বাঁশ কাঠের তুলনায় প্রতি বছর অনেক বেশি বায়োমাস (জৈববস্তু) তৈরি করে।
পরিবেশ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ঢাকার মতো শহরে যেহেতু বড় গাছ লাগানোর জায়গা কম, বাঁশ হতে পারে শহরের ‘গ্রিন ফিল্টার’। রোড ডিভাইডার, ফুটপাতের পাশ, পার্ক, এমনকি ছাদবাগানে বাঁশ লাগিয়ে বায়ু পরিশোধন সম্ভব। বাঁশ দ্রুত বেড়ে ওঠে এবং অল্প জায়গায় ঘন গাছ সৃষ্টি করে, যা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, বাতাস পরিষ্কার এবং শব্দদূষণ কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া বাঁশের শিকড় শক্তিশালী এবং মাটি আঁকড়ে ধরে রাখে। ফলে নদী বা পাহাড়ি এলাকায় বাঁশ বনায়ন মাটির ক্ষয় কমানো ও ভূমিধস রোধে সাহায্য করবে। বাঁশবন বহু পাখি, কীটপতঙ্গ ও ছোট প্রাণীর আবাসস্থল, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে। শহরের উষ্ণতা হ্রাসে বাঁশ প্রাকৃতিক ছাতা হিসেবে কাজ করে। বাঁশ কুটির শিল্প, সবুজ স্থাপত্য, আবাসন নির্মাণ, আসবাবপত্র, এমনকি জ্বালানির উৎস হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। পরিবেশবান্ধব চাষাবাদে বাঁশের গুঁড়া ও পাতা জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
বাঁশের পরিবেশগত গুরুত্ব অনেক বেশি হলেও শহরে পরিকল্পিত বাঁশ বনায়নের উদ্যোগ তেমন দেখা যায় না। নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে প্রাকৃতিক বাঁশবনও ধ্বংস হচ্ছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, বনায়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে আমাদের জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে বেমানান গাছ এনে শহরাঞ্চলে লাগানো হচ্ছে। অথচ, শহরের বিষাক্ত বাতাস শোধন, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বাঁশ হতে পারে একটি সহজ, সস্তা ও কার্যকর সমাধান। পরিকল্পিত বাঁশঝাড় সৌন্দর্যবর্ধনেও কাজে লাগে। বাঁশ চাষকে আরও জনপ্রিয় করতে দরকার সরকারি ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ে পরিকল্পিত বাঁশ বনায়ন কর্মসূচি। নগর পরিকল্পনায় বাঁশকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ছাদবাগানে বাঁশ চাষ উৎসাহিত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া বাঁশ চাষিদের জন্য অর্থনৈতিক প্রণোদনা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি বাঁশকেন্দ্রিক অর্থনীতি চাঙা করা সম্ভব।
তবে বাঁশের পাশাপাশি বহুবর্ষজীবী গাছ হিসেবে কার্বন শোষণে অশ্বথ বা পিপুল গাছকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন গবেষণায়। এতে বলা হয়েছে অন্য গাছ যেখানে শুধু দিনে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে, সেখানে পিপুল গাছ দিনে ও রাতে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে। তবে এক হেক্টর জমির পিপুল গাছ বছরে ১১ টনের মতো কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতে পারে, যা বাঁশের এক-চতুর্থাংশ।
বিডি প্রতিদিন/এমআই