প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক বরফরাজ্য আলাস্কা, যা আমেরিকার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও প্রকৃতির এক অনন্য বিস্ময়। এই ভূমি নিয়ে আমেরিকার অনেকেই একসময় ‘সিওয়ার্ড’স ফলি’ বা ‘সিওয়ার্ডের বোকামি’ বলে উপহাস করেছিল। কারণ ১৮৬৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ৭২ লাখ ডলারে (৭ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার) এটি রাশিয়ার কাছ থেকে কিনেছিল। কিন্তু সেই ‘ভুল’ আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্পদশালী রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি...
দেড় শ বছর আগেও বৃহৎ আলাস্কা ছিল রাশিয়ার। তখন দেশটি মাত্র ৭২ লাখ ডলারে এটি আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দেয়। আজকের দিনে যার মূল্য বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে তেষট্টি কোটির বেশি। এ অর্থ দিয়ে ৫,৮৬,০০০ বর্গমাইলের বিশালাকার আলাস্কা নগরী আমেরিকার হাতে আসে...
১৫০ বছর আগে, ১৮৬৭ সালের ৩০ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট উইলিয়াম এইচ. সিওয়ার্ড এবং রুশ দূত ব্যারন এডুয়ার্ড ডি স্টোকল একটি ‘চুক্তিপত্র’ স্বাক্ষর করেন। মাত্র একটি কলমের খোঁচায়, তৎকালীন জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার আলাস্কাকে মাত্র ৭২ লাখ ডলারে (৭ দশমিক ২ মিলিয়ন) আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দেন। এর মধ্য দিয়ে আলাস্কায় রাশিয়ার ১২৫ বছরের সাম্রাজ্যের সমাপ্তি হয় এবং বেরিং সাগর পেরিয়ে তাদের আধিপত্যের অবসান ঘটে, যা এক সময় সান ফ্রান্সিসকো উপসাগর থেকে ৯০ মাইল দূরে ক্যালিফোর্নিয়ার ফোর্ট রস পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এখন আলাস্কা আমেরিকার (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) অন্যতম ধনী রাজ্য। শুধু তাই নয়- এটি আমেরিকার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের দ্বিগুণ। সহজভাবে বললে- বাংলাদেশের চার গুণেরও বেশি। আলাস্কার আয়তন প্রায় ৫ লাখ ৮৬ হাজার বর্গমাইল। যদিও আমেরিকা যখন রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা ক্রয় করে তখন আমেরিকার ভিতরেই অনেকে এ পদক্ষেপকে ‘বোকামি’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। কারণ তখন আলাস্কা ছিল পাহাড়-পর্বত এবং সমুদ্রে ঘেরা এক জায়গা। জনবসতিও তেমন একটা ছিল না। অন্যদিকে আবহাওয়া ছিল বেশ চরমভাবাপন্ন। কিন্তু সেই আলাস্কা এখন প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার। পেট্রোলিয়াম, সোনা এবং মাছের মতো প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ, সেই সঙ্গে রাশিয়া ও আর্কটিকের প্রবেশদ্বার হিসেবে আমেরিকার কৌশলগত অঞ্চল।
এখন প্রশ্ন হলো- আলাস্কা কেন বিক্রি করেছিল রাশিয়া? এর উত্তর খুঁজতে গেলে দুটি ইতিহাস এবং দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ দেখা যাবে। একটি হলো- কীভাবে রাশিয়া (রুশরা) আলাস্কা ‘দখল’ করেছিল এবং অবশেষে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করে। অন্যটি হলো- মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে, যারা হাজার হাজার বছর ধরে আলাস্কায় বসবাস করে আসছে।
আলাস্কা বিক্রি করার পেছনে রাশিয়ার একটি যুদ্ধের ভূমিকা ছিল, যা ক্রিমিয়ায় শুরু হয়েছিল। এটি সেই ক্রিমিয়া! যা রুশ সাম্রাজ্য ১৭৮৩ সালে দখল করেছিল, পরবর্তীতে অঞ্চলটি স্বাধীন ইউক্রেনের অংশ হয়। কিন্তু ২০১৪ সালে ভøাদিমির পুতিনের রাশিয়া তা পুনরায় দখল করে নেয়। যা ছিল ২০২২ সালের পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আলাস্কা অ্যাংকোরেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ পিয়ার্স ব্যাটেম্যানের মতে, ‘ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এর চেয়ে বড় বিদ্রুপ আর হতে পারে না।’ আজকের দিনে- মাত্র ৭২ লাখ ডলারের বিনিময়ে আলাস্কা কেনা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি অসাধারণ চুক্তি বলে মনে হলেও, সেই সময়ে রুশ সাম্রাজ্যের জন্য এটি একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত ছিল। তবে কিছু রুশ জাতীয়তাবাদী আজও এই হস্তান্তরকে একটি ঐতিহাসিক ভুল হিসেবে দেখেন।
প্রাচ্যের দিকে তাকিয়েছিল রাশিয়া :
১৬ শতক থেকে নতুন ভূমির আকাক্সক্ষা রাশিয়াকে আলাস্কায় এবং শেষ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়ায় নিয়ে আসে। ১৫৮১ সালে প্রাথমিকভাবে এর পরিবর্তন দেখা যায়, যখন রাশিয়া চেঙ্গিস খানের একজন বংশধরের অধীনে থাকা সাইবেরিয়ান অঞ্চল ‘খানাতে অব সিবি’র দখল করে নেয়। যা সাইবেরিয়ার দ্বার খুলে দেয় এবং ৬০ বছরের মধ্যে রুশরা প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছে যায়। এর পেছনে অবশ্য কারণও ছিল, সেগুলো হলো- পশম ব্যবসা, ‘অবিশ্বাসীদের’ মধ্যে রুশ অর্থোডক্স খ্রিস্ট ধর্ম ছড়িয়ে দেওয়া এবং রুশ সাম্রাজ্যে নতুন করদাতা সৃষ্টি করার ইচ্ছা। ১৮ শতকের প্রাক্কালে, রুশ সম্রাট পিটার দ্য গ্রেট- যিনি রাশিয়ার প্রথম নৌবাহিনী তৈরি করেছিলেন, তিনি জানতে চেয়েছিলেন যে- এশিয়ার ভূখণ্ড পূর্ব দিকে ঠিক কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত! তিনি ১৭২৫ সালে ডেনিশ নাবিক ভিটাস বেরিংকে অনুসন্ধানের জন্য আলাস্কার উপকূল পাঠান। তখন থেকেই রাশিয়ার ওই অঞ্চলে আগ্রহ ছিল। সেখানে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে ভোঁদড়, শিয়াল এবং সামুদ্রিক সিলের (ওটার) দামি পশম ছিল। আর জনসংখ্যাও ছিল খুব কম। ১৭৯৯ সালে সম্রাট পল প্রথম ‘রাশিয়ান-আমেরিকান কোম্পানিকে’ আলাস্কা শাসনের অধিকার দেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠানটি সেখানে বসতি গড়ে তোলে। তবে তা ছিল নগণ্য অর্থাৎ ৮০০ জনেরও কম। ১৮০৪ সালে স্থানীয় লিঙ্গিট উপজাতিকে দমন করে সিটকাকে রুশ উপনিবেশের রাজধানী করা হয়।
যখন ‘চ্যালেঞ্জ’ সামনে আসে :
কিন্তু দ্রুতই সমস্যা দেখা দেয়। আসলে আলাস্কায় টিকে থাকা সহজ ছিল না। স্বল্প রুশ অধিবাসীরা তখন রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে অর্ধেক পৃথিবী দূরে থাকার বাস্তবতার মুখোমুখি হয়, তন্মধ্যে বড় সমস্যা যোগাযোগ ব্যবস্থা। যেমন পিটার্সবার্গ থেকে দূরত্ব, বৈরী আবহাওয়া, সরবরাহের অভাব ও আমেরিকার অভিযাত্রীদের প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি। যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমে প্রসারিত হতে থাকায় আমেরিকার ব্যবসায়ীরা রুশ ব্যবসায়ীদের মুখোমুখি হতে থাকেন। রাশিয়ার তখন প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে বড় বসতি ও সেনা মোতায়েন করার মতো পর্যাপ্ত সম্পদ ছিল না। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এ অঞ্চলের ইতিহাসে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর আলাস্কা বিক্রি :
রাশিয়া তুরস্কের দানিউব অঞ্চলে (বর্তমান রোমানিয়া) প্রবেশের পর ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (১৮৫৩-১৮৫৬) শুরু হয়। রুশ সম্প্রসারণ ঠেকাতে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স দুর্বল হয়ে পড়া অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে জোট বাঁধে। যুদ্ধের প্রধান মঞ্চ হয় ক্রিমিয়া উপদ্বীপ। টানা তিন বছর লড়াই শেষে রাশিয়া যুদ্ধে হেরে যায়। এরপরই তারা ঔপনিবেশিক নিয়ে ভাবতে শুরু করে। উনিশ শতক ও বিশ শতকের শুরুর দিকে আমেরিকান পিস সোসাইটির প্রকাশিত ‘অ্যাডভোকেট ফর পিস’ পত্রিকার হিসাব অনুযায়ী, ক্রিমিয়ার যুদ্ধের জন্য রাশিয়া তখনকার হিসেবে ১৬ কোটি পাউন্ড স্টার্লিং খরচ করেছিল। অন্যদিকে অতিরিক্ত শিকার ও ব্যবসায়িক মন্দার কারণে আলাস্কা থেকে তখন খুব কম লাভ আসছিল। উপরন্তু এ অঞ্চল ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত কানাডার কাছে অবস্থিত হওয়ায় ভবিষ্যতে যুদ্ধ হলে ব্রিটেন সহজেই ওই অঞ্চলের দখল নিয়ে নিতে পারবে বলে আশঙ্কা ছিল। ১৮৬০-এর দশকের শুরুতে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার সিদ্ধান্ত নেন, আলাস্কা বিক্রি করবেন। এতে টাকা পাওয়া যাবে এবং ব্রিটেনের হাত থেকে রক্ষা মিলবে। আমেরিকা তখন মহাদেশজুড়ে তাদের আধিপত্য প্রসারিত করছিল। তারা তখন আলাস্কা কিনতে রাজি হয়।
আলাস্কা কেনায় আমেরিকার আগ্রহ :
১৮৪০-এর দশকে আমেরিকা অরিগন পর্যন্ত পৌঁছে যায়, টেক্সাস দখল করে, মেক্সিকোর সঙ্গে যুদ্ধ করে এবং ক্যালিফোর্নিয়া অধিগ্রহণ করে। এরপর সেক্রেটারি অব স্টেট উইলিয়াম এইচ. সিওয়ার্ড ১৮৪৮ সালের মার্চ মাসে লিখেছিলেন- ‘আর্কটিক পর্যন্ত তাদের সম্প্রসারণের ভাবনা রয়েছে।’ এর প্রায় ২০ বছর পর সিওয়ার্ড তার লক্ষ্য অর্জন করেন। আলাস্কায় তখন আমেরিকানরা সোনা, পশম এবং মৎস্য সম্পদের পাশাপাশি চীন ও জাপানের সঙ্গে অধিক বাণিজ্যের সম্ভাবনা দেখতে পায়। তবে আমেরিকানরা ব্রিটেনকে নিয়েও উদ্বিগ্ন ছিল। তবে তারা বিশ্বাস করত, আলাস্কা অধিগ্রহণ আমেরিকাকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। এভাবেই ১৮৬৭ সালের আলাস্কা ক্রয়-বিক্রির চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়। আমেরিকার জন্য ৭২ লাখ ডলার (৭ দশমিক ২ মিলিয়ন) ভালো বিনিয়োগ হয়ে ওঠে। শুধু সম্পদের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৩৭০ মিলিয়ন একর বেশির ভাগ বন্যভূমি লাভ করে- যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের আকারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। যেখানে এখন ২২০০ লাখ একর ফেডারেল পার্ক এবং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। বছরের পর বছর শত শত বিলিয়ন ডলারের তিমি তেল, পশম, তামা, সোনা, কাঠ, মাছ, প্ল্যাটিনাম, দস্তা, সিসা এবং পেট্রোলিয়াম উৎপাদিত হয়ে আসছে- যা রাজ্যটিকে ধনী রাজ্যে পরিণত করে। আলাস্কায় এখনো বিলিয়ন বিলিয়ন ব্যারেল তেলের মজুত রয়েছে।
আলাস্কার আদিবাসীদের ওপর প্রভাব :
১৭৪১ সালে আলাস্কা আবিষ্কারের সময় সেখানে প্রায় ১ লাখ আদিবাসীর বসবাস ছিল। রুশরা অল্প সংখ্যায় থাকলেও কঠোর শাসন চালাত (জিম্মি করা, শিকারি সরঞ্জাম ধ্বংস, অস্ত্রের ভয়)। তবে টলিংইটদের মতো যোদ্ধা জাতিগোষ্ঠী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। রুশ শাসনের ৫০ বছরে যুদ্ধ, রোগ ও দাসত্বে তাদের সংখ্যা ১৭ হাজার থেকে নেমে দাঁড়ায় মাত্র ১,৫০০-তে। ১৮৬৭ সালে আমেরিকার দখলের সময় প্রায় ৫০ হাজার আদিবাসী জীবিত ছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রও তাদের প্রতিপক্ষ মনে করেছিল। আদিবাসীরা দাবি করে, তারা ভূমির প্রকৃত মালিক, যা তারা কোনো দেশকে যুদ্ধ বা চুক্তিতে দেয়নি। তবুও ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়। তারা ভোটাধিকার, সম্পত্তির মালিকানা ও খনিজ দাবির সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে। ১৮৬০-এর দশকে ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারা ধ্বংসে অভিযান চালানো হয়। পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে উপজাতীয় সরকার গঠনের অনুমতি এবং ১৯৪৫ সালে বৈষম্যবিরোধী আইন পাসের মাধ্যমে কিছু অধিকার পায়।
আলাস্কা হলো- দুঃসাহসিক অভিযাত্রী, প্রকৃতিপ্রেমী এবং নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চাওয়া মানুষের জন্য এক স্বপ্নভূমি। এখানে প্রতিটি কোণেই লুকিয়ে আছে নতুন নতুন সব গল্প, যা অন্বেষণের অপেক্ষায় থাকে - তথ্যসূত্র : দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস
সাইবেরিয়ান হস্কি কুকুরগুলো মাঝারি আকারের- সাধারণত এগুলো ২৭ কিলোগ্রামের (৬০ পাউন্ড) কম, দীর্ঘদেহী এবং বিভিন্ন প্রজাতির মিশ্রণে হয়
কী চমৎকার! আলাস্কা ভ্রমণে ওয়াকিং ট্যুরে অংশ নিতে গাইডের সঙ্গে যেতে হবে। তারা সবাই আপনাকে নিতে আসবে, নির্দিষ্ট স্থানে, নয়তো হোটেল থেকে
চমকপ্রদ আলাস্কা
► প্রথম রুশ উপনিবেশ : ১৭৮৪ সালে গ্রিগোরি শেলিখভ প্রথম কোডিয়াক দ্বীপে স্থায়ী রুশ বসতি স্থাপন করেন।
► মিড রাইট সান : গ্রীষ্মকালে (এপ্রিল-আগস্ট) আলাস্কায় সূর্য ২৪ ঘণ্টা উদিত থাকে। বারো (Utqia “vik) প্রায় ৮৪ দিন, ফেয়ারব্যাঙ্কস প্রায় ৭০ দিন সূর্য উপভোগ করে।
► মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম উপকূলরেখা : আলাস্কার উপকূল প্রায় ৬,৬৪০ মাইল দীর্ঘ, ২,৬০০টিরও বেশি দ্বীপ ও অসংখ্য উপসাগর এবং খাঁড়ি নিয়ে গঠিত।
► বিক্রয় কর নেই : আমেরিকার আলাস্কা অঙ্গরাজ্য স্তরে কোনো বিক্রয় কর নেই। তবে স্থানীয় সরকার চাইলে ০% থেকে ৭.৫% পর্যন্ত কর ধার্য করতে পারে।
► জাতীয় উদ্যানের রাজ্য : আলাস্কায় বিশালাকার প্রায় ৮টি জাতীয় উদ্যান রয়েছে, যা মোট জাতীয় উদ্যানের প্রায় ৬০ শতাংশ অঞ্চলজুড়ে আচ্ছাদিত।
► অরোরা বোরিয়ালিস : আলাস্কার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ- উত্তরের আলো বা নর্দার্ন লাইট সারা বছর দেখা যায়। ফেয়ারব্যাঙ্কস হলো এর প্রধান পর্যবেক্ষণ স্থান।
► হিমবাহের দেশ : আলাস্কায় ১,০০,০০০-এরও বেশি হিমবাহ রয়েছে, যা রাজ্যের প্রায় ৫ শতাংশ বিস্তৃত।
► আলাস্কার জনসংখ্যা : বিশাল ভূমি এলাকা থাকা সত্ত্বেও এখানকার জনসংখ্যা মাত্র প্রায়- ৭,৪০,০০০। বৃহত্তম শহর অ্যাঙ্কারিজের জনসংখ্যা ২,৮৯,০০০।
► নদী ও হ্রদ : আলাস্কায় ১২,০০০-এর বেশি নদী এবং ৩০ লাখেরও বেশি হ্রদ রয়েছে। ইউকন নদী দীর্ঘতম, প্রায় ১,৯৮০ মাইল।
► বৃহত্তম বরফক্ষেত্র : জুনো আইসফিল্ড প্রায় ৩,৯০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত।
► ভালুকের রাজ্য : প্রায় ৩০,০০০ বাদামি ভালুক এবং ১,০০,০০০ কালো ভালুকের বসতি।
► সক্রিয় আগ্নেয়গিরি : ৬টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরিসহ রাজ্যে ১৩০-এর বেশি আগ্নেয়গিরি আছে।
স্বপ্ন : ইহুদি রাষ্ট্র গঠন!
জার্মানির নাৎসি বাহিনী যখন ইহুদিদের নৃশংস হত্যায় মেতে ওঠে, তখন প্রস্তাব ওঠে এখানে ইহুদিদের জন্য শরণার্থী ক্যাম্পের। উদ্দেশ্য, জার্মানি ও ইউরোপে নিপীড়িত ইহুদিদের জন্য নিরাপদ আবাস নির্মাণ। এই পরিকল্পনার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন আমেরিকার তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব হ্যারল্ড ইকিস। তবে প্রস্তাবটি প্রবল বাধার মুখে পড়ে, শুধু রাজনৈতিক মহলে নয়, আমেরিকায় বসবাসরত ইহুদিরাও এর বিরোধিতা করে। প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট আশঙ্কা করেছিলেন, এমন সাহসি পদক্ষেপে তিনি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে পারে। তাই কয়েক হাজার ইহুদিকে আমেরিকায় প্রবেশের অনুমতি দিয়ে তিনি থমকে যান, আলাস্কা পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তবে স্বপ্নটি পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। ২০০৭ সালে ঔপন্যাসিক মাইকেল শ্যাবন তাঁর ‘The Yiddish Policemen‘s Union’ উপন্যাসে সেই ধারণাকে জীবন্ত করে তোলেন।
রাজ্য ও স্বীকৃতির ইতিহাস
১৯৫৯ সালে প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার ‘আলাস্কা স্টেটহুড অ্যাক্ট’-এ স্বাক্ষর করেন, যার মাধ্যমে আলাস্কা যুক্তরাষ্ট্রের ৪৯তম রাজ্যে পরিণত হয়। এই আইনের মাধ্যমে ১০৪০ লাখ একর (১০৪ মিলিয়ন একর) জমি নতুন রাজ্যের জন্য বরাদ্দ করা হয়। একই সঙ্গে এক নজিরবিহীন ধারা যুক্ত হয়- সেটি হলো রাজ্যের নাগরিকরা আদিবাসীদের আওতাধীন জমিতে কোনো অধিকার দাবি করবে না। তবে এটি ছিল একটি জটিল প্রশ্ন, কারণ আদিবাসীরা পুরো ভূখণ্ডকে নিজেদের বলে দাবি করত। ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আলাস্কার ৭৫,০০০ আদিবাসীর কাছে ৪৪০ লাখ একর (৪৪ মিলিয়ন একর) ফেডারেল জমি এবং ১০০ কোটি ডলার বিতরণ করেন। এর পেছনে কাজ করে একটি ল্যান্ড ক্লেইমস টাস্ক ফোর্স, যা সমস্যাটির সমাধানে বাস্তবসম্মত প্রস্তাবনা দেয়। বর্তমানে আলাস্কার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৭,৪০,০০০, যার মধ্যে প্রায় ১,২০,০০০ জন আদিবাসী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন আলাস্কার রাজত্ব অর্জনের এই ঐতিহাসিক মাইলফলককে স্মরণ করে, তখন শুধু আলাস্কার মানুষ নয়- আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও যুক্তরাষ্ট্রের বাকি ৪৮টি অঙ্গরাজ্যের নাগরিকদেরও উচিত সেক্রেটারি অব স্টেট উইলিয়াম এইচ. সিওয়ার্ডকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা। কারণ তার দূরদর্শিতা এবং সিদ্ধান্তে আলাস্কার বুকে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল।
বিপজ্জনক উদ্যান অনিয়াকচাক
কয়েকটি জাতীয় উদ্যান যেমন ওয়াইওমিং-এর ইয়েলোস্টোন এবং ক্যালিফোর্নিয়ার ইয়োসেমাইট। প্রতিবছর লাখ লাখ দর্শক আকর্ষণ করে এবং ‘ব্যাককান্ট্রি’ অঞ্চলে গেলে প্রায়ই বন্যপ্রাণী দেখার জন্য গাড়ির লাইন পড়ে থাকে। কিন্তু আলাস্কার আনিয়াকচাক ন্যাশনাল প্রিজার্ভ এগুলো থেকে একেবারেই আলাদা- এটি এতটাই দূরবর্তী ও বিপজ্জনক যে, প্রতিবছর মাত্র কয়েকজন মানুষই এখানে যায়। সড়কপথে এতে পৌঁছানো যায় না; উড়োজাহাজে বা নৌকায় আসতে হয়, আর আলেউটিয়ান উপদ্বীপ তো এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ আবহাওয়া সময়-অসময়ে ভোল পাল্টায়। কখনো প্রবল বাতাস, এমনকি ভারী বৃষ্টিও এর অন্যতম কারণ। আর যদি সময় নিয়ে যেতে পারেন তাহলে এই এলাকায় ব্রাউন ভালুকের দেখা পেয়ে যাবেন। কারণ, অনিয়াকচাক এই রঙের ভালুকের অলিখিত আবাসস্থল।
আলাস্কায় অবিরাম দিন-রাত
আর্কটিকের নিকটবর্তী অবস্থানের কারণে আলাস্কায় কখনো কখনো ২৪ ঘণ্টা দিন এবং রাত থাকে, যা উত্তরের দিকে যত এগোয় তত বেশি প্রভাবশালী হয়। গ্রীষ্মের শুরুতে সূর্য অস্ত যায় না, আর শীতকালে থাকে দীর্ঘ অবিরাম রাতের সময়কাল। ফলে মানুষের মানসিক অবস্থায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোত্তর জনপদ বারোতে, নাগরিকরা সিজনাল অ্যাফেকটিভ ডিজঅর্ডার (Seasonal Affective Disorder) বা ঋতুসংক্রান্ত বিষণ্নতায় আক্রান্ত হন, যা সূর্যের আলো অভাবের কারণে হয়। বারো হলো কাল্পনিক ‘30 Days of Night’ সিরিজের পটভূমি, যে গল্পে ভ্যাম্পায়াররা শহরের নিঃসঙ্গতা ও অন্ধকারের দীর্ঘ সময়কালের সুযোগ নিয়ে রক্তপান করে। এর প্রভাব অবশ্য সবসময় স্পষ্ট নয়; গ্রীষ্মকালে দীর্ঘ সময়ের আলোয় মিষ্টি কুমড়া ও বাঁধাকপি ইত্যাদি অস্বাভাবিক আকারে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
বিতর্কিত তেল পাইপলাইন
১৯৭৩ সালের তেল সংকটের পর, আমেরিকা আলাস্কার মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি তেল পাইপলাইন নির্মাণের অনুমোদন দেয়। ১৯৭৭ সালে এর নির্মাণ শেষ হয়। বর্তমানে এটি দেশের মোট তেল সরবরাহের প্রায় ২০ শতাংশ সরবরাহ করে আসছে। এটি বেসরকারি মালিকানাধীন অ্যালিয়েসকা পাইপলাইন কোম্পানি পরিচালনা করে থাকে- যা BP ও Exxon-সহ কয়েকটি তেল কোম্পানির কনসোর্টিয়াম দায়িত্বে আছে। এই পাইপলাইন প্রুডো বে তেলক্ষেত্র থেকে ভ্যালডিজ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ মাইল অঞ্চলে বিস্তৃত। তবে পাইপলাইনটি বিতর্কমুক্ত নয়। ১৯৭৮ সালে, ফেয়ারব্যাঙ্কসের কাছে পাইপলাইনে ছোট গর্তে প্রায় ১৬,০০০ ব্যারেল তেল ছড়িয়ে পড়ে। ২০০১ সালে, ড্যানিয়েল লুইস নামে এক ব্যক্তি গুলি করে পাইপলাইনে গর্ত তৈরি করলে ৬,০০০ ব্যারেলের বেশি তেল ছড়িয়ে পড়ে। তাকে ১৬ বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা করা হয়।
অদ্ভুত শহর হুইটিয়ার
দুই শর বেশি মানুষের মধ্যে প্রায় সবাই আলাস্কার হুইটিয়ার শহরে বেগিচ টাওয়ার্স নামে ১৪-তলা ভবনে বসবাস করে। বাকিরা তাদের গাড়ি, নৌকা বা অন্য ভবনে থাকে। ১৯৫৬ সালে বেগিচ টাওয়ার্স নির্মিত হয়। তখন এটি সেনাবাহিনীর ব্যারাক হিসেবে ব্যবহার হতো, কিন্তু আজ এটি পূর্ণাঙ্গ শহরে রূপ নেয়। যেখানে আছে পুলিশ স্টেশন, পোস্ট অফিস, দোকান, চার্চ, ভিডিও রেন্টাল শপ, খেলার মাঠ এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্র। সাগরপথই হলো- শহরে প্রবেশের একমাত্র পথ। তবে ৪ কিলোমিটার (২ দশমিক ৬ মাইল) লেন-টানেল দিয়েও যাতায়াত করা যায়, যার দুটি গেট প্রতি ঘণ্টায় দুবার খোলে। রাতে এটি বন্ধ থাকে। ২০০১ সালের আগে, টানেল দিয়ে গাড়ি যেতে পারত না, তখন শহরে প্রবেশের একমাত্র উপায় ছিল ১০০ কিলোমিটার (৬০ মাইল) ট্রেন, যা সপ্তাহে মাত্র কয়েকবার চলত। গ্রীষ্মকালে এখানে প্রায় ২২ ঘণ্টা সূর্যালোক থাকে।
আলাস্কা কেনার সময়- আমেরিকার ভিতরেই অনেকে একে শুধু একটি ঠান্ডা-বরফাচ্ছন্ন ভূমি ভেবে ‘সিওয়ার্ড’স ফলি’ বলেছিলেন। কিন্তু সময়ের পালাবদলে এটি এখন সোনা, কাঠ, পেট্রোলিয়ামসহ বহু সম্পদের ভান্ডার - তথ্যসূত্র : দ্য নিউইয়র্ক টাইমস
ছবির ব্যক্তিটি আমেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেনরি সিওয়ার্ড, যিনি আলাস্কা কেনা নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন
১৮৬৭ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে আমেরিকার আলাস্কা ক্রয়ের চুক্তিকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া ৭.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ট্রেজারি চেক
১৮৯২ সালে আলাস্কার সিটকা নগরী। এই বসতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রুশ ঔপনিবেশিক প্রশাসক আলেকজান্ডার বারানোভ