বন্দরনগরী চট্টগ্রামেই গত শতকের ষাটের দশকের শুরুতে গোড়াপত্তন হয় বাংলাদেশের ইস্পাতশিল্পের। দেশের শিল্পায়নযাত্রার শুরুর দিকে ইস্পাতশিল্প স্থাপন ছিল কেবলই একটি স্বপ্ন। অথচ সীমিত সম্পদ আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি সঙ্গী করে আজকের এ সমৃদ্ধ ইস্পাতশিল্প। আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে, অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে, বিদেশে ইস্পাত রপ্তানি করে নিজেদের সক্ষমতার জানান দিচ্ছে দেশের ইস্পাত প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো। এ শিল্পের পথচলার গল্প যেমন সংগ্রামমুখর, তেমনই অনুপ্রেরণাদায়ক। শিল্পায়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যানবাহন ও জাহাজ নির্মাণ খাতে ইস্পাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছে। রপ্তানি করে অর্জন করছে বৈদেশিক মুদ্রা। পাশাপাশি এ শিল্প হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। ওয়ার্ল্ড স্টিল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু ইস্পাত ব্যবহার ছিল মাত্র ৪৩ কেজি। যেখানে ভারতের ৮১ কেজি এবং চীনের ৬৪৫ কেজি। শিল্পায়ন এবং নগরায়ণের ফলে দেশে দিনদিন বাড়ছে ইস্পাতের ব্যবহার। আগামী এক দশকের মধ্যে দেশে ইস্পাতের ব্যবহার বেড়ে যাবে বহুলাংশে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালে দেশে ইস্পাতের ব্যবহার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে। তখন বাংলাদেশে ইস্পাত ব্যবহার মাথাপিছু ১০০ কেজি ছাড়িয়ে যাবে। ইস্পাতশিল্পের উদ্যোক্তাদের মতে, দেশি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশি ইস্পাতের বাজার সৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক মানের রড উৎপাদনে প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে এ দেশের ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। দেশের ইস্পাতশিল্পে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বে দ্বিতীয় ও এশিয়ায় প্রথম দেশ হিসেবে বিশ্বের সর্বাধুনিক ইস্পাত উৎপাদনের কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তিতে রড উৎপাদন করছে বাংলাদেশের জিপিএইচ ইস্পাত। জানা যায়, গত শতকের ষাটের দশকের শুরুতে ১৯৬০ সালে সরকারি উদ্যোগে চিটাগাং স্টিল মিলস লিমিটেড (সিএসএম) প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের সামগ্রিক ইস্পাতের চাহিদা মেটাতে পতেঙ্গায় সরকারি উদ্যোগে চিটাগাং স্টিল মিলস লিমিটেড (সিএসএম) প্রতিষ্ঠিত হয়। জাপানের কোবে স্টিল লিমিটেডের সহায়তায় ১৯৬৭ সালে ওপেনহার্থ ফার্নেস টেকনোলজিসম্পন্ন কারখানাটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায়। এটি ছিল দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সরকারি ইস্পাত কারখানা। সিএসএমে ঢেউটিন, লয়েডস গ্রেডের প্লেট, কোল্ড রোল্ড সিট, ইনগট ও বিলেট উৎপাদন করা হতো। এখানে উৎপাদিত বিলেট ব্যবহার করেই রি-রোলিং মিলগুলো বাংলাদেশের অধিকাংশ ইস্পাতের চাহিদা পূরণ করত। শুধু তা-ই নয়, এখানে উৎপাদিত প্লেট ব্যবহার করে শিপিয়ার্ড ও ড্রাই ডকগুলোও চাহিদা পূরণ করত। সিএসএমে উৎপাদিত ঢেউটিনের সুনাম আজ অবধি মানুষের মুখে মুখে। অনেক ঘরের চালে এখনো অক্ষত রয়েছে সে সময়ের সিএসএমের উৎপাদিত টিন। দীর্ঘ এ সময় অক্ষত থাকার বড় কারণ ওপেনহার্থ ফার্নেসে পরিপূর্ণ রিফাইনিং সুবিধা। তাই এটি দিয়ে অত্যন্ত উন্নতমানের ইস্পাত বানানো যেত। কিন্তু ওপেনহার্থ ফার্নেসের কাঁচামাল ও জ্বালানি ব্যবহারের ফ্লেক্সিবিলিটি থাকলেও উৎপাদন ক্ষমতা ছিল অনেক কম। উৎপাদন খরচের সমন্বয়ের কারণে এ প্রযুক্তি উপযুক্ততা হারাতে থাকে। চাহিদার সর্বোচ্চ থাকা অবস্থায় ১৯৯৯ সালে উপমহাদেশের একটি গৌরবোজ্জ্বল ও উচ্চমানের ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিএসএমকে সরকার বন্ধ ঘোষণা করে; যার ফলে বাংলাদেশ সরকার ইস্পাতশিল্প ও ইস্পাতপণ্যের মান ধরে রাখার ক্ষেত্রে তার অভিভাবকত্ব হারায়। এ সুযোগে ইস্পাত উৎপাদনের সবচেয়ে অগ্রহণযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব নয় এমন একটি প্রযুক্তি ইন্ডাকশন ফার্নেস ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। ভারত থেকে আনা ইন্ডাকশন ফার্নেস প্রযুক্তি বাংলাদেশে ইস্পাত উৎপাদনে অধিক হারে ব্যবহার করা হয়। অথচ ভারতের নামকরা ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এ প্রযুক্তি ব্যবহার এড়িয়ে অন্য প্রযুক্তি দিয়ে ইস্পাত উৎপাদন করছিল তখন। ভারতে যেসব প্রতিষ্ঠান ইন্ডাকশন ফার্নেসের মাধ্যমে ইস্পাত উৎপাদন করে সেসব প্রতিষ্ঠানকে পেছনের সারির ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হতো। পৃথিবীর উন্নত দেশের ইস্পাত উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড ও ইস্পাত উৎপাদনে জড়িত বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন, ইন্ডাকশন ফার্নেস দিয়ে উচ্চমান বা স্পেশাল কোয়ালিটির ইস্পাত উৎপাদন অর্থনৈতিকভাবে খুবই দুরূহ। তাই দেশের ইস্পাতশিল্পের উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ ইন্ডাকশন ফার্নেসের পরিবর্তে নতুন প্রযুক্তিতে ইস্পাত উৎপাদনে চিন্তাভাবনা শুরু করেন; যার ফলে এখন আমাদের দেশে ইন্ডাকশন ফার্নেস শুধু নয়, কনভেনশনাল ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসকে ছাপিয়ে বর্তমান বিশ্বের সর্বাধুনিক ইস্পাত উৎপাদনের কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসের আবির্ভাব হয়। বিশ্বে দ্বিতীয় ও এশিয়ায় প্রথম হিসেবে বাংলাদেশের জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় স্থাপিত হয়েছে সর্বাধুনিক এ প্রযুক্তি। এর পরই দেশের ইস্পাতশিল্পের সর্বাধুনিক এ প্রযুক্তি নিয়ে হইচই শুরু হয়। পরে এ প্রযুক্তি দেখার জন্য ভারতের টাটা স্টিল থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন, ভিয়েতনাম, তুরস্ক, মিসর, সৌদি আরব প্রভৃতি দেশ থেকে ইস্পাতশিল্পের উদ্যোক্তা ও তাদের প্রতিনিধিরা ছুটে আসতে থাকেন বাংলাদেশে। এ প্রযুক্তি অনুসরণ করেই উন্নত দেশের ইস্পাতশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্তরা এ ধরনের কোয়ালিটিসম্পন্ন ও পরিবেশবান্ধব ইস্পাত কারখানা স্থাপন করছেন বা স্থাপনের পরিকল্পনা করছেন। তারা বাংলাদেশে এসে এ ধরনের স্টেট অব আর্ট কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেস সংবলিত ইস্পাত কারখানা পরিদর্শন করে এ দেশের ইস্পাতশিল্পের উচ্চমান সম্পর্কে ধারণা নিয়ে যাচ্ছেন। এতে উজ্জ্বল হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি। জিপিএইচ ইস্পাতের রড উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। রড উৎপাদনে কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস ব্যবহার করার ফলে উৎপাদিত ইস্পাত অন্যান্য ফার্নেসের তুলনায় উন্নতমানের হয়। স্ক্র্যাপ প্রি-হিটিং টেকনোলজি, অপদ্রব্যমুক্ত গলিত ইস্পাত উৎপাদন, অক্সিজেন, কার্বন, লাইম, ডলোলাইম, নাইট্রোজেন ও আর্গনের সঠিক ব্যবহার, সেকেন্ডারি রিফাইনিং ও সুষম রাসায়নিক মিশ্রণ এবং হাইস্পিড কাস্টিংয়ের মতো উন্নত প্রক্রিয়াগুলো জিপিএইচ ইস্পাতের গুণগত মান নিশ্চিত করে। বিশেষ করে স্ক্র্যাপ প্রি-হিটিং টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সাশ্রয় এবং বিশুদ্ধ ইস্পাত উৎপাদন সম্ভব হয়। জিপিএইচ ইস্পাত টেকসই উন্নয়নে বিশ্বাসী এবং পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশি ইস্পাতশিল্প এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অটোমেশন লেভেল ২.৫ ও ইন্ডাস্ট্রি লেভেল ৪.০সমৃদ্ধ স্টেট অব আর্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী স্টিলের গুণগত মান নিশ্চিত করছে জিপিএইচ। জিপিএইচ ইস্পাত রপ্তানি খাতে একটি বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করেছে। চীনে বিলেট রপ্তানি করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি প্রমাণ করেছে জিপিএইচের রড আন্তর্জাতিক মানের।
ড. সৈয়দ ফখরুল আমিন, সাবেক অধ্যাপক, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
বেশি রিফাইনিংয়ের জন্য মানের দিক থেকে অনন্য
বাজারে থাকা অন্য যে কোনো প্রযুক্তিতে উৎপাদিত রডের চেয়ে কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তিতে উৎপাদিত রডের মান ভালো বলে জানান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ ফখরুল আমিন। তিনি বলেন, ‘কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসে উৎপাদিত রডে ইমপিউরিটিস বা অপদ্রব্য কম থাকে। ফলে এর মান অন্যান্য প্রযুক্তিতে উৎপাদিত রডের চেয়ে অনেক ভালো। অন্যদের রড ভালো তবে কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসের রড আরও ভালো। অর্থাৎ অন্যদের রড যদি ৭০ পেয়ে পাস করে, কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস ব্যবহার করে উৎপাদিত রড ৯০ পেয়ে পাস করবে। দেশের সব কোম্পানির রডই আসলে পাস করে। পাস না করলে তো আসলে বাজারে ছাড়ার অনুমতি পেত না। কিন্তু পাস করার মধ্যেও পার্থক্য আছে, কেউ অল্প মার্কস পেয়ে পাস করছে। আবার কেউ খুব ভালো মার্কস নিয়ে পাস করছে। এখানে এ পাস করার মধ্যেও পার্থক্য আছে।’ কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস এবং অন্য সব ফার্নেস দিয়ে উৎপাদিত স্টিলের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিষয়ে তিনি বলেন, আসলে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। সবই ফার্নেস এবং সবই লোহা গলাতে ব্যবহৃত হয়। লোহা যখন গলে, তখন লোহার মধ্যে থাকা অপদ্রব্য যেগুলো লোহা থেকে হালকা, সেগুলো গলিত লোহার ওপরে ভাসতে থাকে যাকে স্ল্যাগ বলে। ওপরের এ অপদ্রব্যগুলো ফেলে দেওয়া হয়। অপদ্রব্যের নিচে থাকা গলিত লোহাকে সাইফনিক ট্যাপিং পদ্ধতির মাধ্যমে ট্যাপ করা হয়। কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস ব্যবহারের সুবিধা হলো এখানে তাপমাত্রার ওপর নিয়ন্ত্রণ বেশি থাকে। ইলেকট্রিসিটি কম ব্যবহৃত হয়। অন্যান্য ইস্পাত মেকিং পদ্ধতির থেকে কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসে অপদ্রব্য নিষ্কাশনব্যবস্থা ভালো। এটি অন্য ইস্পাত মেকিং পদ্ধতি থেকে কম ইলেকট্রিসিটি ব্যবহার করে সমপরিমাণ লিকুইড মেটাল বা গলিত লোহা উৎপাদন করতে পারে।
কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তিনি বলেন, কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। সবাই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী। তাই এ প্রযুক্তি সারা বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। যদিও কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তির দাম বিগত প্রযুক্তি থেকে বেশি হওয়ায় সবাই এখনো এ প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করতে পারছে না। আমরা যারা ইঞ্জিনিয়ার রয়েছি আমাদের কাজ হচ্ছে মূলত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসা এবং দাম যত সম্ভব কমানোর চেষ্টা করা; যাতে সবার নাগালের মধ্যে আসে। তবে দাম নাগালের মধ্যে আনার জন্য সেফটি বাদ দেওয়া যাবে না। সস্তা করতে গিয়ে যদি আমরা কোয়ালিটি নষ্ট করে ফেলি তাহলে ওই সস্তা জিনিস আসলে সস্তা না। বরং লং টার্মে চিন্তা করলে ওই সস্তা জিনিসের দাম আরও বেশি পড়ছে।
প্রফেসর ড. রাকিব আহসান, পুরকৌশল বিভাগ (বুয়েট)
ইস্পাতশিল্পে প্রযুক্তির উন্নয়ন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছে
এখন কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে জিপিএইচ ইস্পাত, আধুনিক কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বমানের ইস্পাত উৎপাদনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে
‘বাংলাদেশের ইস্পাতশিল্পে প্রযুক্তির উন্নয়ন দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে’ এমন মন্তব্য করেছেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. রাকিব আহসান। তাঁর মতে একসময় বাংলাদেশে ইনডাকশন ফার্নেস প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে ইস্পাত উৎপাদন হতো। যেখানে স্টিলের বিশুদ্ধতা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধতা ছিল। তবে এখন কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে জিপিএইচ ইস্পাত, আধুনিক কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বমানের ইস্পাত উৎপাদনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। জার্মানির Simens এবং জাপানের Mitsubishi-এর যৌথ উন্নয়ন PRIMETALS-এর এ প্রযুক্তি প্রি-হিটিংয়ের মাধ্যমে অপদ্রব্য আলাদা করে কেমিক্যাল ও মেকানিক্যাল গুণ আরও নির্ভরযোগ্য করে তোলে। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য slag free tapping and Ladle Refining Furnace. যা ইস্পাতের বিশুদ্ধতা ও উৎপাদনের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে। পুরো প্রক্রিয়াটি একটি ইন্টিগ্রেটেড প্ল্যান্টের অংশ, যেখানে স্ক্র্যাপ থেকে রড পর্যন্ত সবকিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়। পরিবেশবান্ধব দিকেও জিপিএইচ উদাহরণ স্থাপন করেছে। পুনর্ব্যবহৃত পানি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, বৃহত্তম অক্সিজেন প্ল্যান্ট এবং পরিবেশ অধিদপ্তর ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের স্ট্যান্ডার্ডের নিচে গ্যাস নিঃসরণ ইত্যাদি এ প্রক্রিয়ার অংশ। এ ছাড়া দেশে প্রথমবারের মতো বাজারে আনা হয়েছে ৬০০ গ্রেড রড, যা উচ্চ শক্তি ও নমনীয়তার ফলে কাঠামোগত নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে এবং পরিবেশগতভাবে টেকসই নির্মাণে সহায়ক। কম রড ব্যবহার, কম কনজেশন, উন্নত কংক্রিটিং, বিদ্যুৎ ও পানির সাশ্রয় এ গ্রেডের মূল সুবিধা। এ রড বাজারজাতের আগে BUET-এর সঙ্গে যৌথ গবেষণা করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৪২০ বা ৫০০ গ্রেডের তুলনায় ৬০০ গ্রেড রড কাঠামোগত দিক থেকে আরও কার্যকর। এর পরে তারা PWD, MIST-এর সঙ্গেও গবেষণা করে ভালো ফল পেয়েছে। এমনকি জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও ভবিষ্যৎ গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে উন্নত প্রযুক্তি, গবেষণাভিত্তিক পণ্য উন্নয়ন এবং পরিবেশ-সচেতনতা এ তিনের সমন্বয়ে জিপিএইচ ইস্পাত দেশের নির্মাণশিল্পে একটি আশাব্যঞ্জক মডেল তৈরি করছে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এম শামিম জেড বসুনিয়া, শিক্ষাবিদ ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞ
কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেস গুণগত উৎকর্ষতায় নতুন মানদণ্ড
কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসে তৈরি রড গুণগত উৎকর্ষতায় নতুন এবং গুণগত মানের দিক দিয়ে বিশ্বের সেরা। এ প্রযুক্তিতে উৎপাদিত ৬০০ গ্রেডের ইস্পাত ব্যবহারের ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রডের খরচ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সাশ্রয় হয়-এমনটাই দাবি করেছেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এম শামিম জেড বসুনিয়া।
কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসের বিষয়ে প্রখ্যাত এ বিশেষজ্ঞ বলেন, কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসে তৈরি রডের গুণগত মান খুব ভালো। যে প্রক্রিয়ায় রড উৎপাদন করা হয় এটা ‘ওয়ান অব দ্য বেস্ট ওয়েজ অব ডুয়িং ইট’। বাংলাদেশে আরও দু-একটি কোম্পানি এ প্রযুক্তিতে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কারণ এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে খুবই হাইগ্রেড ইস্পাত বানানো সম্ভব। এ হাইগ্রেড ইস্পাত ব্যবহার করলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত রডের খরচ কম হতে পারে। বিল্ডিংয়ের বিম এবং কলামে সাশ্রয়টা বেশ লক্ষণীয়। যদি রডের ব্যবহার ২০ শতাংশ কমে যায়, তখন কংক্রিটিং করতে ভালো হবে, যা স্টার্কসের জন্য খুব ভালো। ১ সিএফটি কংক্রিটের দাম স্ট্রেন্থ টু স্ট্রেন্থ ভেরি করে ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু ১ সিএফটি রডের দাম ৪৯০ পাউন্ডের কাছাকাছি হয় মানে ২২৫ কেজি। ২২৫ কেজির দাম কত? যদি প্রসেসিং খরচসহ ১০০ টাকা করে প্রতি কেজি রডের দাম হয় তাহলে ২২ হাজার ৫০০ টাকা সেভ হয়; যা সাংঘাতিক রকম। এতে রড কমাতে পারলে স্ট্রাকচার ভালো হয়। বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার অধ্যাপক ড. রাকিব হাসানের গবেষণার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ড. রাকিব হাসান দেখিয়েছেন এ ইস্পাত ব্যবহার করলে তার চেয়ে কম গ্রেড যেগুলোর আছে তাদের তুলনায় পার্টিকুলার ভূমিকম্পপ্রতিরোধী কন্ডিশনে বা তার জয়েন্টগুলোতে কী অবস্থা হয়। তাদের যে টেস্টিং রেজাল্ট পেয়েছেন সেগুলো সব ভালো। তারা দেখিয়েছেন বাংলাদেশের মার্কেটের ৬০০ এমপিএ বা ৮৭,৫০০ পিএসআই গ্রেডএ ৫০০ এমপিএ (৭২,৫০০ পিএসআই) গ্রেড এবং ৪২০ গ্রেটের তুলনায় রড যেহেতু কম লাগে। কনজেশন কম হয়। এটা দিয়ে তৈরি করলে বিম এবং কলামের জয়েন্টগুলো আরও ভালো হয়। এটার একটা বিরাট ফাইন্ডিংস টেকনিক্যাল সাইড থাকে। আর্কিটেকরা অনেক সময় বলেন কলামটা ছোট করতে। সেজন্য বলছি ইস্পাতের স্ট্রেন্থ যদি বেশি ভালো হয় তাহলে সুউচ্চ বিল্ডিংয়ে ব্যবহার ভালো, কনজেশন এবং খরচ অনেক কম হয়। ক্ষেত্রবিশেষ খরচ আপ টু ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কম হয়। সঙ্গে আরও একটা ব্যাপার জড়িত। যেমন একটা স্ট্রাকচারে যদি ১০ টন ইস্পাত ব্যবহার হয় তাহলে ১০ টন ইস্পাতকে ফেব্রিকেট করতে হয়। কিন্তু যদি ৬০০ গ্রেড রড ব্যবহারে ২০ শতাংশ সাশ্রয় হয়, অর্থাৎ ৮ টন রড ব্যবহার হয় তখন সে অনুপাতে লেবার খরচ এবং ডাইরেক্ট-ইনডাইরেক্ট অন্যান্য খরচ সেভ হয়। দ্বিতীয় হলো, এ গ্রেডের ট্রেন্টের ইস্পাত ব্যবহার করলে ভূমিকম্প রেজিস্ট্যান্স হয়। ভূমিকম্পের সময় বিল্ডিং হেলেদুলে রিভার্স স্ট্রেসের ঘটনা ঘটে। জিপিএস ইস্পাত লিমিটেড বাজারে কোয়ান্টাম টেকনোলজি নিয়ে এসেছে অলমোস্ট পাঁচ বছরের কাছাকাছি হলো। এটা খুবই সাহসী রকম পদক্ষেপ। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এটা খুবই ভালো সিদ্ধান্ত। কারণ এর জন্য বিরাট ফ্যাক্টরি ও ইনভেস্টমেন্ট লাগে। এটা করতে গেলে ব্যাসিক কনসিডারেশন লাগে। তার মধ্যে একটা হলো, এ রকম ইস্পাত বানাতে অক্সিজেন প্ল্যান্ট লাগে। এ ইস্পাত বানাতে গেলে প্রচুর পানি লাগে, জায়গা লাগে। তারা এ ব্যাপারগুলোতে নজর দিয়েছে। যেমন তাদের অক্সিজেন প্ল্যান্টটা অনেক বড় এবং বেশি অক্সিজেন বানায়। কারণ অক্সিজেন ছাড়া এ রকম বিশুদ্ধ ইস্পাত বানানো যায় না। নিয়মটা হচ্ছে, স্টিলের যে কাঁচামাল তা গলিয়ে ফেলতে হয় ১৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় অক্সিজেনের উপস্থিতিতে। তা ছাড়া বিগত কভিডের সময় বাংলাদেশকে অনেক অক্সিজেন দিয়েছে। এটা একটা বিরাট বেনিফিট টু দ্য সোসাইটি। এখন তারা ইস্পাত বানানোর পরে অতিরিক্ত অক্সিজেন বাংলাদেশে বিক্রি করে, যা বিভিন্ন হাসপাতালে কাজে লাগে।
নেক্সট হচ্ছে, ইস্পাত তৈরিতে অনেক পানি লাগে। জিপিএইচ ইস্পাত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে না। রাঙামাটির কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে ড্যামের মতো করে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পাহাড়ের মধ্যে বাঁধ দিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে। সারা বছর এ পানি ইস্পাত তৈরিতে ব্যবহার করে। তা ছাড়া তাদের ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে পিউরিফাই করে ব্যবহার করে। এটা একটা বড় বেনিফিট। তারা ভূগর্ভস্থ পানি নেয় না। ন্যাচারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাদের এ ব্যবস্থাপনা। তারা এ প্ল্যান্ট করতে গিয়ে প্ল্যান্টের যে অফ গ্যাস আছে তার সঙ্গে যে কার্বন মনোক্সাইড এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড বের হয় এ গ্যাসটা তারা পিউরিফাইয়ের মাধ্যমে ট্রিটমেন্ট করে পরিবেশে ছাড়ে। বাংলাদেশের যে স্ট্যান্ডার্ড আছে এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের যে স্ট্যান্ডার্ড, তার চেয়েও তারা কম এমিশন বা নির্গমন মেনটেইন করে।
অধ্যাপক ড. মো. তারেক উদ্দিন, সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল বিভাগ ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি)
মেগা স্ট্রাকচারের জন্য প্রয়োজন উচ্চ মানের ইস্পাত
উচ্চশক্তির ইস্পাতের প্রয়োজনীয়তা বর্তমানে অপরিহার্য। বিশেষত সুউচ্চ ভবন, মেগা স্ট্রাকচার ও দীর্ঘ স্প্যানের সেতুর জন্য। লো-স্ট্রেংথ ইস্পাত ব্যবহার করা গেলেও বেশি পরিমাণে প্রয়োজন হওয়ায় কংক্রিটের সঠিক কভারেজ নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে; যা কাঠামোর দুর্বলতার কারণ হতে পারে। ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে উচ্চমানের ইস্পাত ব্যবহারের গুরুত্ব আরও বেশি। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের (বিএনবিসি) কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও আমেরিকান কংক্রিট ইনস্টিটিউটের (এসিআই) উন্নত সংস্করণ ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে; যা হাই-স্ট্রেংথ স্টিলের ব্যবহার সমর্থন করে। আমাদের দেশে মাথাপিছু ইস্পাত ব্যবহারের পরিমাণ উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক কম; যা এ খাতে উন্নয়নের বিশাল সম্ভাবনা নির্দেশ করে। এমনটাই জানালেন ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) গাজীপুরের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. তারেক উদ্দিন। তিনি বলেন, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে কাঠামোর নমনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ গ্রেডের ইস্পাত ব্যবহার করে কংক্রিটের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে কাঠামোর স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব হয়। যদিও উচ্চ গ্রেডের ইস্পাতের সঙ্গে উচ্চ গ্রেডের কংক্রিট ব্যবহারের সামঞ্জস্য ভালো। তবে কংক্রিটের ব্যবহার নিশ্চিত করাটাই মুখ্য বিষয়।
ইস্পাত উৎপাদনে কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস এবং পানি রিসাইকেল করার মতো আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিবেশের ওপর চাপ কমানো যায়। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব।
অধ্যাপক ড. আসিফুল হক, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)
এ শিল্প এগিয়ে নিতে প্রয়োজন প্রণোদনা
দেশের ইস্পাতশিল্প এগিয়ে নিতে সরকারের উচিত বেশি করে প্রণোদনা দেওয়া। এ শিল্প এগিয়ে গেলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। সৃষ্টি হবে আরও কর্মসংস্থান। এমনটাই দাবি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফুল হকের। তিনি বলেন, জিপিএইচ চীনসহ বিভিন্ন দেশে ইস্পাত রপ্তানি করছে। তারা মানুষের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করছে। এ প্রতিষ্ঠান খুবই ভালো কাজ করছে। প্রণোদনা দেওয়া গেলে আরও ভালো কাজে উৎসাহিত হবে। কারখানা তো অনেকেই করছে। কিন্তু জিপিএইচ যা করছে, তা খুব কম কারখানার মালিক করেছে। তারা মানুষের জন্য করছে। পরিবেশের জন্য করছে। যারা ভালো কাজ করছে, তাদের এনকারেজ করা উচিত। তারা বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সাফল্যও দেখিয়েছে। এখন তাদের যদি সহায়তা করা হয়, তাহলে এ প্রতিষ্ঠান আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে। এতে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে। সৃষ্টি হবে আরও কর্মসংস্থান। তাঁর মতে, কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস ইস্পাতশিল্পে পৃথিবীর সবচেয়ে সাশ্রয়ী প্রযুক্তি। কোয়ান্টাম প্রযুক্তিতে প্রিহিটিং করা হয় মেইলটিং করার জন্য। এতে ইলেকট্রিসিটি কনজাম্পশন কম হয়। পাশাপাশি অক্সিজেন নাইট্রোজেন গ্যাস সেপারেশন করে; যা অন্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ প্রযুক্তিতে ওয়াটার রিসাইক্লিং করে ভূগর্ভস্থ ও উপরিভাগের পানির ওপর চাপ কমানো হচ্ছে। কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসে এনার্জি কনজাম্পশন অন্যান্য ফার্নেসের তুলনায় কম।
অধ্যাপক ড. আবদুল কাদের, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট)
ভূমিকম্পসহনশীল কাঠামো নির্মাণে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত
বাংলাদেশে ভূমিকম্পসহনশীল কাঠামো নির্মাণে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট) গাজীপুরের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল কাদের। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ইস্পাত উৎপাদনে পুরোনো প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা ছিল। যেখানে বিশুদ্ধতা ও উন্নতমানের ইস্পাত তৈরিতে সমস্যা হতো। বর্তমানে উন্নত টিএমটি (থার্মো মেকানিক্যাল ট্রিটমেন্ট) প্রযুক্তি কার্বনের পরিমাণ না বাড়িয়েও উচ্চশক্তি এবং পর্যাপ্ত নমনীয়তাসম্পন্ন ইস্পাত উৎপাদনে সক্ষম। এর ফলে ভূমিকম্পসহনশীল কাঠামো নির্মাণে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। আধুনিক কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তি ইস্পাত উৎপাদনে দক্ষতা বৃদ্ধি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে; যা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের (এসডিজি) সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বে কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তির ওপর জোর দেওয়ার কারণ হলো এর দক্ষতা, উন্নত মেকানিক্যাল প্রপার্টি এবং পরিবেশবান্ধবতা। হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের মতো কাঠামোয় উচ্চশক্তির ইস্পাতের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে; যা এ প্রযুক্তির মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব। তবে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের (বিএনবিসি) সীমাবদ্ধতার কারণে এখনো উচ্চ গ্রেডের ইস্পাতের ব্যবহার তেমনভাবে শুরু হয়নি। যে কারণে ভূমিকম্পে অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যায়।
এ বিশেষজ্ঞের মতে, ভূমিকম্পের ঝুঁকির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রস্তুতি এখনো অপ্রতুল। তাই উচ্চশক্তি ও উচ্চ নমনীয়তাসম্পন্ন ইস্পাতের ব্যবহার ভূমিকম্পসহনশীল নিরাপদ ভবিষ্যৎ নির্মাণে অপরিহার্য।
আব্দুল্লাহ আল হোসাইন চৌধুরী রিজভী, ইঞ্জিনিয়ার
খরচসাশ্রয়ী ডাকটাইল স্ট্রাকচার ডিজাইন করতে ৬০০ গ্রেডের রড অনেক কার্যকর
‘ডাকটাইল স্ট্রাকচার ডিজাইন করতে ৬০০ গ্রেডের রড অনেক কার্যকর’ এমনটাই বললেন ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লাহ আল হোসাইন চৌধুরী রিজভী। তিনি বলেন, এতে খরচও কম। সম্প্রতি আমরা যেসব ভূমিকম্প দেখেছি তাতে লক্ষ করেছি কিছু কিছু বিল্ডিং নিমিষেই মাটির সঙ্গে মিশে গেছে কিন্তু কিছু কিছু বিল্ডিং দুলতে দুলতে টিকে গেছে। এ দুলতে দুলতে টিকে যাওয়াকেই আমরা ডাকটাইল স্ট্রাকচার বলি। এর জন্য ডিজাইন, কনস্ট্রাকশন ও উচ্চমানের রডের ভূমিকা অনেক। ৬০০ গ্রেডের রড এ ক্ষেত্রে অনেক কার্যকর, একই সঙ্গে খরচসাশ্রয়ী। তিনি আরও বলেন, আমি সরেজমিনে জিপিএইচের কারখানা পরিদর্শন করে যতটুকু জেনেছি, ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান Primetals Technologies Ltd.-এর সহায়তায় বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস (QEAF) প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করেছে জিপিএইচ ইস্পাত। উন্নতমানের ইস্পাত উৎপাদন, শক্তি-দক্ষতা ও পরিবেশ সংরক্ষণের সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে এটা করা সম্ভব বলে আমার মনে হয়। আমি যতটুকু বুঝেছি, প্রচলিত ইন্ডাকশন বা সাধারণ ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসে স্ক্র্যাপ প্রিহিটিং ব্যবস্থা না থাকায় শক্তি খরচ বেশি হয়, কিন্তু কোয়ান্টাম প্রযুক্তিতে স্ক্র্যাপ প্রিহিটিংয়ের মাধ্যমে গলন সময় কমে এবং প্রতি ৩৫-৪০ মিনিটে ৮০ টন তরল ধাতু উৎপাদন সম্ভব হয়। রডের গুণগত মান নির্ধারণে কেমিক্যাল কম্পোজিশনের সঠিক নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে কার্বন, ম্যাংগানিজ, সালফার ও ফসফরাসের পরিমাণ। QEAF প্রযুক্তির মাধ্যমে এ উপাদানগুলো নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় বলে মনে হয়েছে।