এবার কোরবানির ঈদ গরমে পড়ায় ফ্রিজ বা রেফ্রিজারেটরের বাজার তুঙ্গে। ক্রেতারা এরই মধ্যে সাধ ও সাধ্যের মিল রেখে নিজেদের পছন্দের ফ্রিজ কিনতে শুরু করেছেন। অনেকেই ঈদের ঠিক আগে কিনবেন, এখন বাজার ঘুরে ফ্রিজ যাচাইবাছাই করছেন। ফ্রিজের বাজার ঘুরে দেখা যায়, ক্রেতার চাহিদার কথা মাথায় রেখে দেশি ফ্রিজ কোম্পানিগুলোও নতুন নতুন প্রযুক্তির সর্বাধুনিক ফ্রিজ দিয়ে সাজিয়েছে তাদের শোরুম। ঈদ উপলক্ষে ক্রেতাদের জন্য আছে বিশেষ অফারও। শহর তো বটেই, গ্রামের সচ্ছল ও মধ্যবিত্তরা বাড়িতে খাবার সংরক্ষণে ফ্রিজ কিনছেন অনেক আগে থেকেই। কিন্তু এক দশক আগেও প্রত্যন্ত গ্রামের অনেক বাড়িতেই খাবার সংরক্ষণের বিশেষ এ যন্ত্র ছিল না। দেশি ফ্রিজ কোম্পানিগুলো এ দৃশ্য অনেকটা বদলে দিয়েছে। তাদের উৎপাদিত সাশ্রয়ী মূল্যের ফ্রিজ ও কিস্তি সুবিধায় শহর ও গ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষও এখন ফ্রিজ কিনছেন। দাম অনেকটা হাতের নাগালে চলে আসায় এবং বিদ্যুতায়নের কারণে গ্রামের অনেক বাড়িতেই এখন ফ্রিজ দেখা যায়। কাঁচা মাছ-মাংস সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় সে সময় গ্রামের মানুষ প্রতিদিনই বাজার করতেন। মাঝেমধ্যে যাদের বাড়িতে ফ্রিজ ছিল তাদের ফ্রিজে কাঁচা মাছ-মাংস রেখে আসতেন। আশার কথা এ দৃশ্য এখন পুরোনো। ঘরে ঘরে ফ্রিজ থাকায় গ্রামীণ জনপদের জীবনযাপন এখন আগের চেয়ে অনেকটাই সহজ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও বিভিন্ন দেশি ফ্রিজ কোম্পানির দেওয়া তথ্যে, বর্তমানে দেশে ফ্রিজের বাজার ১০ থেকে ১১ হাজার কোটি টাকার ওপরে। প্রতি বছর দেশে ফ্রিজের বাজার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন শহর ও গ্রামাঞ্চলে ছোট পরিবারের কারণে ক্রেতাদের ফ্রিজ কেনার পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে ফ্রিজের বার্ষিক চাহিদা ৩০ লাখ ইউনিটের বেশি। আর ফ্রিজের চাহিদার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বর্তমানে পূরণ হয় দেশি কোম্পানির রেফ্রিজারেটর দিয়ে।
বিভিন্ন ফ্রিজ কোম্পানির দায়িত্বশীলরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, বর্তমানে কর্মব্যস্ত জীবনে গ্রাম ও শহর সব জায়গাতেই জীবণন সহজ করে তুলেছে ফ্রিজ। শহরে নিউক্লিয়ার বা একক পরিবারগুলোতে স্বামী-স্ত্রী উভয়ই কর্মজীবনে ব্যস্ত থাকায় মাসের বা সপ্তাহের বাজার ফ্রিজে সংরক্ষণ করেন। রেফ্রিজারেটরের মাধ্যমে রান্না করা বা কাঁচা খাবার দীর্ঘ সময় তাজা রাখা সম্ভব হয়। এতে প্রতিদিন বাজারে যাওয়ার প্রয়োজন কমে এবং সময় বাঁচে। কর্মজীবী মানুষ একবারে বেশি রান্না করে ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে পারেন, যা সময় ও পরিশ্রম দুটোই সাশ্রয় করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সারা বছরের মোট বিক্রির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ফ্রিজ শুধু দুই ঈদেই বিক্রি হয়। এ কারণে এ সময়ে ফ্রিজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের ফ্রিজে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের চেষ্টা করে। আবার ক্রেতা আকর্ষণে তারা বিভিন্ন ঈদ অফারও দেয়। ঈদ উপলক্ষে ক্রেতাদের জন্য বিভিন্ন দেশি ফ্রিজ কোম্পানি আইওটি, এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ বিশ্বের সর্বাধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ও ফিচারসমৃদ্ধ নতুন মডেলের ফ্রিজ এনেছে। আর এ ফ্রিজগুলোর দামও যৌক্তিক ও সহনশীল। আছে ফ্রিজ কেনায় বিশেষ ইএমআই সুবিধা। এ ছাড়া ঈদের বিশেষ অফার হিসেবে পণ্য কেনায় ফ্রিজ কোম্পানিগুলো স্ক্র্যাচ কার্ড ঘষলেই চমকপ্রদ পুরস্কার জিতে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এর মধ্যে আছে সোনার অলংকার, কোরবানি পশু, ইনস্ট্যান্ট ক্যাশব্যাকসহ পণ্য কেনায় বিশাল ছাড়ের সুযোগ।
রাজধানীর বাড্ডার বাসিন্দা শফিকুর রহমান গুলশান-১ নম্বরে অবস্থিত ইলেক্ট্রো মার্টের শোরুমে সম্প্রতি ফ্রিজ দেখতে আসেন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার বাসার ফ্রিজটা পুরান হয়ে গেছে। সামনেই কোরবানির ঈদ। এজন্য নতুন ফ্রিজ কিনতে এসেছি। এখনকার ফ্রিজগুলোতে এত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় যে কোনটা ছেড়ে কোনটা কিনব তা নিয়ে দ্বিধায় পড়েছি। তবে দামে সাশ্রয়ী এবং মানে ভালো এমন ফ্রিজই কিনব।’ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশি ফ্রিজ কোম্পানিগুলো ফ্রিজে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে; যা ক্রেতাদের এসব পণ্য কেনায় আরও আকৃষ্ট করছে। ফ্রিজে অ্যান্ড্রয়েড ডিসপ্লে এবং স্টেরিও সাউন্ড সিস্টেম, এমএসও (ম্যাট্রিকস স্পিড অপটিমাইজেশন) প্লাস ইনভার্টার টেকনোলজি, ‘এআই ডক্টর’ ফিচার, ইন্টেলিজেন্ট জার্ম টার্মিনেটর টেকনোলজি, ডোর অ্যালার্ম সিস্টেম, গার্ডেন ফ্রেশ টেকনোলজি, অ্যাকটিভ কার্বন প্রযুক্তিসহ আরও সব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল লাইনিং, ক্রেতাবান্ধব মূল্যনীতি, বিক্রয়োত্তর সেবা নিশ্চিত করায় দেশের ফ্রিজের বাজার দিনদিন বাড়ছে। পাশাপাশি গ্রাহকবান্ধব সেবা নিশ্চিতে ফ্রিজ কোম্পানিগুলো গড়ে তুলেছ দক্ষ টেকনিশিয়ান টিম। এজন্য কোম্পানিগুলো দেশব্যাপী বিস্তৃত সার্ভিস সেন্টার স্থাপন করেছে। পণ্যে কোনো অসুবিধা হলেই আছে সুনির্দিষ্ট হটলাইনে অভিযোগ জানানোর সুযোগ।
দেশি ফ্রিজের বাজার সম্পর্কে জানতে চাইলে দেশের বিভিন্ন ফ্রিজ কোম্পানির দায়িত্বশীলরা বলেন, তাঁরা ফ্রিজের বাজার সম্প্রসারণসহ রপ্তানি বাজার বৃদ্ধির জন্য অন্তর্বর্তী সরকার থেকে নীতিসহায়তা আশা করছেন। একই সঙ্গে এটি দীর্ঘমেয়াদি করার পাশাপাশি রপ্তানির জন্য নীতিমালা তৈরি করা গেলে দেশে উৎপাদিত ফ্রিজেরও পোশাক খাতের মতো বিকাশের সুযোগ আছে। এভাবে সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করা হলে পুরোনো বিনিয়োগকারীরাও তাঁদের ব্যবসা সম্প্রসারণে যেতে পারবেন। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। অর্থনীতি লাভবান হবে।
এ উদ্যোক্তারা আরও বলেন, দেশি ফ্রিজের বাজার সম্প্রসারণে তাঁরা এ খাতের অটোমেশন, পণ্য গবেষণা ও উদ্ভাবনে জোর দিয়েছেন। পাশাপাশি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিত্যনতুন প্রযুক্তি ও ফিচারের পণ্য উদ্ভাবনের লক্ষ্যে গবেষণা ও উদ্ভাবনেও প্রতিনিয়ত বিনিয়োগ করছেন।
দেশি ফ্রিজ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ফ্রিজ রপ্তানির ভবিষ্যৎ অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশে ইলেকট্রনিকস খাত, বিশেষ করে ফ্রিজ উৎপাদন শিল্প, গত এক দশকে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তি, দক্ষ জনশক্তি এবং সরকারের সহায়ক নীতির ফলে দেশি ফ্রিজ স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বহির্বিশ্বেও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এরই মধ্যে দেশি ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে ওয়ালটন ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, ইরাক, ইয়েমেন, নাইজেরিয়া, তুরস্ক, অস্ট্রিয়াসহ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপের ৪০টির বেশি দেশে রেফ্রিজারেটরসহ ফ্রিজের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ রপ্তানি করছে। গত অর্থবছরে কোম্পানিটি প্রায় ২ লাখ ইউনিট ফ্রিজ রপ্তানি করেছে। ২০২৬ সালের মধ্যে ৫ লাখ ইউনিট ফ্রিজ রপ্তানির টার্গেট রয়েছে ওয়ালটনের। এজন্য ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত বিশ্বে রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে কোম্পানিটি কাজ করছে। গঠন করেছে সুদক্ষ এবং চৌকশ গ্লোবাল বিজনেস টিম। পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ইলেক্ট্রো মার্ট কোম্পানি অল্প সময়ের মধ্যে ফ্রিজ রপ্তানির জন্য প্রস্তুত বলে জানা যায়। তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যেহেতু ফ্রিজ একটি ইলেকট্রনিকস পণ্য তাই এটি দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার করার জন্য তারা গ্রাহকদের বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। ফ্রিজের চারপাশে পর্যাপ্ত জায়গা রাখতে হবে যাতে বাতাস ভালোভাবে চলাচল করতে পারে। এটি ফ্রিজের কুলিং সিস্টেমের কার্যকারিতা বাড়াবে। ফ্রিজের দরজা সঠিকভাবে বন্ধ রাখতে হবে। ফ্রিজ অতিরিক্ত ওভারলোড হতে দেওয়া যাবে না। খাবারের জন্য প্রতিদিন বেশি সময়ের জন্য ফ্রিজ খুলে রাখা যাবে না। এতে ফ্রিজের কার্যক্ষমতা কমে যায়। দীর্ঘদিন ফ্রিজ ব্যবহারের জন্য ব্যবহারকারীকে নিয়মিত পরিষ্কার (ডিপ ক্লিনিং) করতে হবে। গ্যাস্কেট পরীক্ষা করতে হবে। তাপমাত্রা সেটিং ঠিক রাখতে হবে। খাবার ঢেকে রাখতে হবে। বছরে একবার ফ্রিজ সার্ভিসিং করতে হবে।