‘এলাকার এক খারাপ লোক ভয় দেহাইয়া দিনদুপুরে আমার মাইয়াডারে ধর্ষণ করছে। মাইয়াডার অবস্থা এহন গুরুতর। আমি গরিব মানুষ। যে আমার মাইয়ার এত বড় সর্বনাশ করছে, আমি হ্যার বিচার চাই!’
এভাবেই বলছিলেন রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় ধর্ষণের শিকার শিশুটির বাবা।
তিনি বলেন, ‘আমি হোটেলে কাম করি। বউডা ছোট বাচ্চাডারে লইয়া বাসাবাড়িতে কাম করে। বড় মাইয়াডা ঘরে একাই থাকত। এই সুযোগে এলাকার এক খারাপ লোক মাইয়াডার সর্বনাশ করে!’
এই বলে কাঁদতে থাকেন তিনি। শিশুটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি হয়েছে।
এমন ঘটনা একটি নয়, দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সম্প্রতি বেড়ে গেছে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) মাসিক অপরাধমূলক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম ৯ মাসে দেশে ৬৬৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে শিশু রয়েছে ৩৯৭ জন। প্রতি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ৭৩.৬৭ শতাংশ। দিনে ধর্ষণের ঘটনার শিকার দুজনের বেশি।
এইচআরএসএসের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, সারা দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এতে সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর আরো তৎপর হওয়া উচিত।
পুলিশ সদর দপ্তরের মাসিক অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত আট মাসে দেশের বিভিন্ন থানায় নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ১৫ হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। সেই হিসাবে গড়ে প্রতি মাসে এক হাজার ৮৭৯টি মামলা হয়েছে। প্রতিদিন মামলা ৬০টির বেশি।
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। হালুয়াঘাট থানার ওসি হাফিজুল ইসলাম বলেন, গত সোমবার রাতে এ ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তার পরিবারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সম্প্রতি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে এই তথ্য গেছে। ৮ সেপ্টেম্বর সকালে কুমিল্লার কালিয়াজুরী এলাকায় ভাড়া বাসা থেকে ওই শিক্ষার্থী ও তাঁর মায়ের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
একই মাসে চাঁদপুরে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। ২১ সেপ্টেম্বর রাতে গাজীপুরের শ্রীপুরে শুটিংয়ের কথা বলে রিসোর্টে নিয়ে এক নারী নাট্যকর্মীকে (২৪) দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে।
অপরাধ বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি করতে হবে। বিলম্বিত বিচার ও তদন্ত প্রভাবিত করার কারণে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে।
একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নথিপত্রে তথ্য-প্রমাণাদি সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না। আবার ধর্ষণের বিচার বছরের পর বছর ঝুলতে থাকলে বাদীপক্ষ সামাজিক নানা ধরনের বাধা ও হেনস্তার শিকার হয়ে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।
এইচআরএএসের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে জানা গেছে, গত আট মাসে এক হাজার ৫২২ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে ৯ জন। এর মধ্যে সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে কমপক্ষে ১৫৯ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার অন্তত ৫৫ জন, যাদের মধ্যে ৩০ জন (৫৪%) ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. মোস্তফা কামাল বলেন, নানা কারণে সমাজে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এক হাজার ৪৪০, ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার ৪৩০, মার্চে দুই হাজার ৫৪, এপ্রিলে দুই হাজার ৮৯, মে মাসে দুই হাজার ৮৭, জুনে এক হাজার ৯৩৩, জুলাইয়ে দুই হাজার ৯৭ ও আগস্টে এক হাজার ৯০৪টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। সব মিলিয়ে গত আট মাসে দেশের বিভিন্ন থানায় মোট মামলা হয় ১৫ হাজার ৩৪টি।
মহিলা পরিষদের চলতি বছরের আগস্টের তথ্য বলছে, আগস্টে দেশে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২২৩ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১১৫ জন হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে কন্যাশিশুরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। গত সোমবার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ৫২৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৬৬ জনই শিশু। ধর্ষণের পর ২৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আত্মহত্যা করেছে ছয়জন। এসব ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪৩৫টি এবং ৮৭টি ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলার তথ্য পাওয়া যায়নি।
মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রকাশিত সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্টে ৪৭টি ধর্ষণের ঘটনা সেপ্টেম্বরে বেড়ে ৫৩টি হয়েছে। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ১৩টি এবং ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা তিনটি। মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, ধর্ষণসহ সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমরা তৎপর রয়েছি।
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ