যেখানে অসম বিভাজন রয়েছে, সেখানে অনিবার্য নিয়ম এটাই যে- এ যদি ওপরে উঠে ও তবে নিচে নামবে। বাংলাদেশেও অবিকল তাই ঘটেছে। সাধারণীকরণ নানাভাবে করা যাবে, একটি হবে এরকমের যে স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে ব্যক্তি উঠেছে, নেমে গেছে সমষ্টি। কোনো একটি ক্ষেত্রে নয়, আলাদাভাবেও ঘটেনি, ঘটেছে সর্বত্র। ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির অসম বিভাজনটি নতুন নয়, অতি পুরাতন; এবং বহুকাল ধরেই সত্য এটা যে ব্যক্তিস্বার্থ যত উন্নত হয়েছে ততই অবনত হয়েছে সামগ্রিক স্বার্থ।
কিন্তু এরকমটা হওয়ার কথা ছিল না, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরে। মুক্তির লক্ষ্য অবশ্য ব্যক্তির উন্নতিই; যেকোনো অগ্রগতির চূড়ান্ত পরীক্ষা ওইখানেই ঘটে, ব্যক্তির লাভ-লোকসানে; কিন্তু সে ব্যক্তি অল্প কয়েকজন নয়, তারা হচ্ছে সবাই, সমগ্র জনগোষ্ঠী। লক্ষ্য ছিল সব মানুষের মুক্তি, নইলে সবাই যোগ দেবে কেন, স্বাধীনতার আন্দোলন রূপ নেবে কেন জনযুদ্ধের? কিন্তু যুদ্ধ শেষে দেখা হয়েছে নবীন আশা জয়ী হয়নি, কায়েম রয়েছে সেই পুরোনো নীতি; অল্প কিছু মানুষের উন্নতি, বাদবাকি মানুষদের অবনতি। এটা আগেও ঘটেছে, এবারও ঘটল। চকিতে তাকিয়ে দেখা যাক। ১৯৪৫-৪৬-এ এ দেশে একটি প্রায়-বিপ্লবী পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। মনে হচ্ছিল জনগণের অভ্যুত্থান ঘটবে, রাষ্ট্রক্ষমতা চলে যাবে সাধারণ মানুষের হাতে। সেটা যাতে না ঘটে তার জন্য তড়িঘড়ি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আন্দোলনরত মানুষকে ঠেলে-ধাক্কিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে নির্বাচনের সরু ও অন্ধ গালিতে। ফলে স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিণত হয়েছে কংগ্রেস ও লীগের ক্ষমতাদ্বন্দ্বে এবং পরিণামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও বঙ্গ বিভাগের মতো ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। লাভ হয়েছে কতিপয়ের, বোঝা বহন করতে হয়েছে জনগণকে।
তারপর পূর্ববঙ্গে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন; সে আন্দোলন আরও অনেক দূর এগোত যদি আন্দোলনের ফলে গঠিত ও সুফলপ্রাপ্ত মুসলিম লীগ বিরোধী যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনবিজয়ী নেতারা ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে ভয়ংকর কলহ না বাধাতেন। সেটাও কতিপয়ের তৎপরতাই, অধিকাংশের সংগ্রামে বৈরী সুযোগকে কুক্ষিগত করার; সংক্ষেপে লুটপাটের। ওই সুযোগে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল। এরপরে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে উনিশ শ ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান। সেবারও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছিল জনগণকে শান্ত করতে, অখণ্ড রাষ্ট্রের আশা ছিল কতিপয়ের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করা যাবে, বাদবাকিদের বঞ্চিত করে। কিন্তু জনগণ রায় দিয়েছে আপসের বিপক্ষে এবং সংগ্রামের পক্ষে। নির্বাচন নয়, দাঙ্গা নয়, সামরিক শাসন মেনে নেওয়া নয়। রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়েছে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানি শাসকদের সব হিসাবনিকাশ এবং পরে গণহত্যা ও নৃশংসতাকে পরাভূত করে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ।
জনগণের দিক থেকে আশা ছিল মৌলিক পরিবর্তন ঘটবে। বিপ্লব আসবে সামাজিক ব্যবস্থায়, বদলে যাবে ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির পূর্ববর্তী সংঘাতপূর্ণ সম্পর্ক; সবার উন্নতির মধ্য দিয়েই উন্নতি ঘটবে ব্যক্তিমানুষের; কিন্তু সেটা ঘটেনি। ব্যক্তি বড় হয়ে উঠেছে সমষ্টির প্রশস্ত ঘাড়ে পা রেখে। ফলে সমষ্টি তো নেমেছেই, ব্যক্তিও উঁচু হতে পারেনি। বাঙালি আগেও প্রান্তবর্তী ছিল এখনো সেই প্রান্তবর্তীই রয়ে গেল। ব্যক্তিস্বার্থের সঙ্গে ব্যক্তিস্বার্থের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সংঘর্ষের রূপ নেয়। একেবারে উঁচু থেকে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র ওই একই ঘটনা, একই রকমের কলহ, দাঙ্গাহাঙ্গামা, ছিনতাই, খুনাখুনি। পথেঘাটে ছিনতাই হয়, হবেই; রাষ্ট্রক্ষমতাও তো ছিনতাই হয়ে গেছে, একাধিকবার। এরশাদ যে রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনতাই করেছিলেন, সেটাও কতিপয়ের স্বার্থে এবং রাজনীতিকদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের সুযোগ ব্যবহার করে। এরশাদ সরকারের পতন ঘটেছে গণ অভ্যুত্থানের ভিতর দিয়ে। পরিণতিতে নির্বাচন পাওয়া গেছে। একাধিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে; কিন্তু তাতে পুরাতন নীতির কোনো বরখেলাপ ঘটেনি, জনগণের তেমন একটা লাভ হয়নি, লাভ হয়েছে কিছু মানুষের।
জনগণের শ্রমের সৃষ্ট ফসল আত্মসাৎ করে এই যে ব্যক্তির উত্থান, একে আর যা-ই হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্মত বলার কোনো উপায় নেই। উল্টোটাই বলা সংগত, যদিও বলা হয়নি। সত্য হচ্ছে এটা যে মুক্তিযুদ্ধ অল্প কিছু মানুষের মুক্তি চায়নি, অন্য সবাইকে বন্দি রেখে। মুক্তি চেয়েছে সবার, যাতে মুক্তি ঘটে প্রত্যেকের। সেটাই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যার অপর নাম প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা। সে গণতন্ত্র অবৈধ স্বৈরাচারের জায়গাতে বৈধ স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা নয়, মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠা বটে। কতিপয়ের যে শাসন দেশে প্রতিষ্ঠিত তা নির্বাচনের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হোক, কিংবা প্রতিষ্ঠা পাক জবরদখলের সাহায্যে, তাকে স্বৈরাচার ভিন্ন অন্য কিছু বলার উপায় নেই, উপায় থাকে না।
এটা কেবল যে বাংলাদেশে ঘটছে তা নয়, ঘটছে সমগ্র পুঁজিবাদী বিশ্বে। পুঁজিবাদের মূল দর্শনটা এ রকমের যে যোগ্যরা টিকবে, অযোগ্যদের হটিয়ে দিয়ে। তারাই যোগ্য যাদের পুঁজি আছে; কিংবা যারা পুঁজির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত; যারা শ্রমজীবী তারা অবশ্যই অযোগ্য। ওই যোগ্যরা যে শাসনব্যবস্থা চালু রাখে, সেটা তাদের অর্থাৎ অল্পসংখ্যকের স্বার্থকেই পুষ্ট করে এবং জনগণের স্বার্থকে পদদলিত করে। যোগ্যদের এ শাসনের নানাবিধ কুফল জ্বলজ্বল করতে থাকে। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আদর্শস্থল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভোট কারচুপি হয়, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে জাপানে প্রধানমন্ত্রী, সরকারের বড় বড় কর্তা ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়েন। অপরাধ ঘটে যত্রতত্র। পুঁজিবাদ নিজেই একটি অপরাধ, মস্ত বড় অপরাধ। তার শক্তি উদ্বৃত্ত মূল্য অপহরণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ওই উদ্বৃত্ত মূল্য আপনা আপনি সৃষ্টি হয় না, শ্রমজীবীরাই তা সৃষ্টি করে, নিজেদের শ্রম দিয়ে। শীর্ষ অপরাধী যে নিজেই তার পক্ষে অজস্ত্র অপরাধের জন্ম দেওয়াটাই স্বাভাবিক এবং জন্ম সে দিচ্ছেও বটে। অপরাধীর শাস্তি দেওয়ার দায়িত্বও আবার ওই ব্যবস্থারই হাতে; কিন্তু নিজেই যে অপরাধের জন্মদাতা এবং জন্ম অপরাধী, সে কী করে অপরাধীকে শায়েস্তা করবে। পারছে না সেটা করতে, যেজন্য অপরাধ বাড়তেই থাকবে, বৃদ্ধি পায় আদালত ও উকিলের সংখ্যা, হ্রাস পায় না অপরাধীদের ক্রমবর্ধমানতা। বাংলাদেশেও অবিকল সেটাই ঘটছে। ঘটতে থাকবে যদি রুখে না দাঁড়ানো যায়।
পুঁজিবাদীব্যবস্থার একটি অবদান হচ্ছে মৌলবাদ, যা এখন বেশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে এবং সমগ্র বিশ্বের জন্যই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবান নামক দুর্বৃত্তরা ফ্যাসিবাদী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়ে তারা জনগণের সব মৌলিক অধিকারই হরণ করে নিয়েছে। মেয়েদের বিশেষভাবে কোণঠাসা করেছে, টিকতে দিচ্ছে না প্রাচীন প্রস্তর মূর্তিগুলোকেও। দুই হাজার বছর আগের বৌদ্ধমূর্তিগুলো ধ্বংস করে নিজেদের বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল। তালেবানদের ওই কাজের নিন্দা করেনি, এমন দেশ নেই বললেই চলে। কিন্তু ওই দুর্বৃত্তরা দমেনি। ফ্যাসিবাদীরা দমে না। হিটলার যেমন করে বই পুড়িয়েছে, তালেবানরাও তেমনি করেই মূর্তি ভেঙেছে।
বিশ্বব্যাপী ধিক্কার ধ্বনিতে এ সত্যটি যেন তলিয়ে না যায় যে তালেবানরা উৎপাদিত হয়েছে পুঁজিবাদীদের কারখানাতেই। প্রত্যক্ষভাবে যেমন, তেমনি অপ্রত্যক্ষভাবেও। প্রত্যক্ষ যোগাযোগটা সবারই জন্য থাকার কথা। সমাজতন্ত্রীদের উৎখাত করার জন্য মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ পাকিস্তানের মাদরাসাগুলোতে যে যুবকদের লালনপালন করেছে, অর্থ দিয়েছে, সুযোগ দিয়েছে অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানের, তারাই পরে তালেবান নাম নিয়ে আফগানিস্তান দখল করে নিয়ে মৌলবাদী এক ব্যবস্থা কায়েম করেছে। তাদের শত্রু ছিল সমাজতন্ত্রীরা; সমাজতন্ত্রীরা এখন মাঠে নেই, সেই শত্রুকে সামনে না পেয়ে তালেবানরা এখন উদারনীতিকদের শত্রু করে তুলেছে।
এ ঘটনা প্রত্যক্ষ। দৈত্য যখন কাজ না পায় তখন মনিবের ঘাড়ে হাত দেয়। দৈত্যের সব কাজই অন্যায় ক্রিয়া, অন্যায় ছাড়া সে থাকতে পারে না। পারে না বলেই এখন তাদের দৌরাত্ম্য সভ্যতাবিধ্বংসী রূপ পরিগ্রহ করেছে। পুঁজিবাদী বিশ্ব এক দৈত্যকে নিবৃত্ত তো পরের কথা, নিয়ন্ত্রিতও করতে পারছে না। দৈত্য বড়ই বেয়াড়া। কিন্তু পুঁজিবাদের সঙ্গে মৌলবাদের যে দ্বন্দ্ব সেটা গভীর নয়, মৌলবাদের গভীর ও মৌলিক দ্বন্দ্ব হচ্ছে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে মৌলবাদ এবং পুঁজিবাদের মধ্যে মিলবার কোনো জায়গা নেই। মৌলবাদ পশ্চাৎপদ, পুঁজিবাদ হচ্ছে আধুনিক। চেহারাসুরত, পোশাকপরিচ্ছদ সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী। কিন্তু দুয়ের মধ্যে আদর্শগত ঐক্য বিদ্যমান রয়েছে এবং কেমন করে অস্বীকার করব এই সত্য যে আদর্শিক ঐক্যই হচ্ছে মূল ব্যাপার, তার বাইরে যা রয়েছে তা অমৌলিক, অনেকাংশে পোশাকি। আদর্শিক ঐক্যটা এখানে যে উভয় মতবাদী ব্যক্তির স্বার্থকে প্রধান করে তোলে সমষ্টির স্বার্থকে উপেক্ষা ও পদদলিত করে।
মৌলবাদীরা মোক্ষ খোঁজে। সে মোক্ষ অবশ্যই ব্যক্তিগত। তাদের ধর্ম চর্চাটাকে মনে হয় অলৌকিক, আধ্যাত্মিক; কিন্তু আসলে সেটা পুঁজি সঞ্চয়। তাদের পুণ্য এক প্রকারের পুঁজি বটে, ব্যক্তিগত পুঁজি; এর ক্ষেত্রে ইহকাল-পরকাল উভয় ভূমি পর্যন্ত প্রসারিত। তারাও মুনাফাতন্ত্রী। নিজের পুঁজি বৃদ্ধির জন্য মৌলবাদীরা অন্যের ওপর অত্যাচার করে, মানুষ মারতে পর্যন্ত পিছপা হয় না, মূর্তি ভাঙতে তাদের হাত কাঁপে না। অন্ধকারকে লালন করে, অন্ধবিশ্বাসকে উত্তেজিত করে তোলে, সমষ্টিগত অগ্রগতিকে ঠেলতে থাকে পেছন দিকে। সবাইকে পিছিয়ে দিয়ে নিজেরা এগোতে চায়। নিজেরা নয়, চূড়ান্ত বিচারে প্রত্যেক মৌলবাদীই ব্যক্তিগত, নিজের জন্য কাজ করছে; নিজের মুক্তি ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ