আমেরিকায় একসময় দাঁতের চিকিৎসা বা রান্নার উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হতো নাইট্রাস অক্সাইড, যা ‘লাফিং গ্যাস’ নামে পরিচিত। এখন তা ভয়ঙ্কর নেশার বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
এর প্রধান কারণ- সহজলভ্যতা ও ফ্লেভারযুক্ত প্যাকেজিং। সেই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ‘মাতাল হওয়ার’ ভিডিওগুলোও এর পেছনে অন্যতম কারণ। এসবের মাধ্যমে লাফিং গ্যাসের প্রতি আসক্তি বাড়ছে তরুণ প্রজন্মের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নেশা শুধু ক্ষতিকর নয়, বহু ক্ষেত্রে প্রাণঘাতীও।
ফ্লোরিডার মেগ ক্যাল্ডওয়েল ছিলেন এমনই একজন তরুণী, যিনি নাইট্রাস অক্সাইডের সহজলভ্যতা ও আরামদায়ক অনুভবের ফাঁদে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শুরু করা এই গ্যাস ব্যবহার একসময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কোভিডের সময় ব্যবহার বেড়ে গিয়ে দিনে দিনে ভয়ঙ্কর আসক্তিতে রূপ নেয়। তিনি দোকান থেকে ‘ভেপ’ কিনে গাড়ির পার্কিং লটে বসে একের পর এক টান দিতেন, অনেক সময় একদিনেই শত ডলার খরচ করতেন। শেষ পর্যন্ত ২০২৩ সালের নভেম্বরে একটি ভেপ শপের বাইরেই প্রাণ হারান তিনি।
ক্যাল্ডওয়েলের মৃত্যু কোনও ব্যতিক্রম নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ‘পয়জন সেন্টারের’ তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ সালে স্বেচ্ছায় নাইট্রাস অক্সাইড ব্যবহারের ঘটনা ৫৮ শতাংশ বেড়েছে। এই পদার্থের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে হাইপোক্সিয়া হতে পারে, যা এমন একটি অবস্থা, যখন মস্তিষ্কে অক্সিজেন পৌঁছায় না। এর ফলে মৃত্যু হতে পারে।
নাইট্রাস অক্সাইডের নিয়মিত ব্যবহারে স্নায়ু ও মেরুদণ্ডে স্থায়ী ক্ষতি, এমনকি পক্ষাঘাত পর্যন্ত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) জানায়, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এই গ্যাসের বিষক্রিয়াজনিত মৃত্যুর সংখ্যা ১১০ শতাংশ বেড়েছে।
এই বিপজ্জনক উত্থানের পেছনে রয়েছে বাজার ব্যবস্থার অসংগতি ও বেপরোয়া বিপণন কৌশল। পূর্বে যেসব দোকানে আট গ্রাম ক্যান কিনে বেলুনে গ্যাস নিয়ে ব্যবহার করা হতো, করোনার পর সেসব দোকান ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে দুই কেজি পর্যন্ত ক্যানিস্টার সহজলভ্য হয়ে যায়।
‘গ্যালাক্সি গ্যাস’ ও ‘মায়ামি ম্যাজিক’-এর মতো ব্র্যান্ডগুলো রঙিন, আকর্ষণীয় প্যাকেজিংয়ে পণ্যের বিপণন শুরু করে। কম্পিউটার গেমস ও টিভি সিরিজের চরিত্র দিয়ে মোড়ানো এই পণ্য তরুণদের আরও বেশি আকৃষ্ট করে।
‘পার্টনারশিপ টু এন্ড অ্যাডিকশন’ সংস্থার প্যাট অসেম বলেন, বড় ক্যান মানেই অনেক লোক একসঙ্গে চেষ্টা করতে পারে, এতে পিয়ার প্রেশার আরও বেড়ে যায়। ‘পিয়ার প্রেশার’ বা দলগত চাপ হলো সমবয়সী বা একই দলের বন্ধুদের দ্বারা সৃষ্ট এক ধরনের মানসিক চাপ, যা কোনও ব্যক্তিকে তাদের মতো করে কাজ করতে বা চিন্তা করতে প্রভাবিত করে। এটি ইতিবাচক বা নেতিবাচক উভয়ই হতে পারে।
বিষয়টিকে আরও জটিল করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওগুলো। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে একটি ফাস্টফুড রেস্তোরাঁ থেকে আপলোড করা এক ভিডিওতে দেখা যায়, এক তরুণ স্ট্রবেরি-ক্রিম ফ্লেভারের গ্যাস টেনে ‘আমি লিটল টি ম্যান’ বলে চিৎকার করছেন। কয়েক সেকেন্ড পর তার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে নাইট্রাসের প্রতিক্রিয়ায়। ভিডিওটি প্রায় ৪ কোটিবার দেখা হয়েছে ও সেটির অনুকরণে হাজার হাজার ভিডিও তৈরি হয়েছে।
র্যাপ মিউজিক ভিডিও, টুইচ স্ট্রিমিং ও জনপ্রিয় জো রোগান শোতেও নাইট্রাস অক্সাইডের ব্যবহার দৃশ্যমান। এমনকি র্যাপার ইয়ে (পূর্বে কানিয়ে ওয়েস্ট) তার দাঁতের চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ‘বেপরোয়া পরিমাণে’ নাইট্রাস সরবরাহের অভিযোগ এনে আইনি পদক্ষেপ নেন।
যুক্তরাজ্য এরই মধ্যে ২০২৩ সালে নাইট্রাস অক্সাইড নিজের কাছে রাখা অবৈধ ঘোষণা করেছে। অনেক দেশেই এর বিনোদনমূলক ব্যবহার নিষিদ্ধ। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে এখনও রান্নায় ব্যবহৃত পণ্য হিসেবে এটি বৈধ এবং বেশিরভাগ রাজ্যে খুচরা বিক্রিও বৈধ। শুধু লুইজিয়ানাতে এই গ্যাসের বিক্রি পুরোপুরি নিষিদ্ধ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যতক্ষণ না এই ব্যবস্থার ফাঁকফোকর বন্ধ হচ্ছে, আর বিপণনে কড়া বিধি আরোপ করা হচ্ছে, ততদিন তরুণদের মধ্যে এই মরণনেশা ঠেকানো যাবে না। আর তা না হলে, আরও অনেক মেগ ক্যাল্ডওয়েল হারিয়ে যাবে অকালে—একটি ‘লাফিং গ্যাস’ যে শেষ হাসি হাসছে, সেটা হয়তো আমরা টেরই পাচ্ছি না। সূত্র: বিবিসি বাংলা
বিডি প্রতিদিন/একেএ