জুলাই সনদ নিয়ে নতুন করে সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঐক্য করার চেষ্টার ফল বৃহত্তর অনৈক্য সৃষ্টিও হতে পারে। এতে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণায় প্রভাব পড়তে পারে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তুত করা প্রস্তাব সব রাজনৈতিক দলের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে। শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে হওয়া ঐকমত্য কমিশনের অর্ধশতাধিক বৈঠক নিষ্ফল হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আলোচনার টেবিল সচল রয়েছে। তবে খোলা এই টেবিলে এখন তেমন আর আগ্রহ নেই রাজনৈতিক দলগুলোর। শুরুতে নির্ধারিত সময়ে সবাই সংলাপে অংশ নিলেও এখন কেউ আসছেন দেরিতে, আবার কেউ হাজিরা দিয়েই ছুটছেন বাইরে। ৩০টি রাজনৈতিক দল এ কমিশনের সংলাপে অংশ নিলেও মূলত তিন থেকে চারটি দলের মতের ওপর ফোকাসটাই বেশি। বলতে গেলে প্রায় সবাই তাকিয়ে রয়েছে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির ঐকমত্যের ওপর। কিন্তু মূল কয়েকটি ইস্যুতে তাদের মতপার্থক্য আকাশ-পাতালের মতো ফারাক।
শেষ কয়েকটি বৈঠকে ‘চাপ’ আর ‘বাধ্য’ এ দুটি শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তাই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যকে গুরুত্ব দেওয়া হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে কেউ কেউ রাজনৈতিক দলগুলোর কাউন্সিলের গল্প শোনাচ্ছেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক সদস্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কাউন্সিল শুরু হয় সন্ধ্যা ৬টায়। শুরুতে অনেক বক্তব্য শোনা যায়। দলীয় নেতারা মাইক নিয়ে ঝড় তুলে বলেন-এটা করব, সেটা করব। কিন্তু কাউন্সিল পাস হয় রাত আড়াইটায়। তখন কেউ ঘুমায়, কেউ ঝিমায়, আবার কেউ উধাও।
কোনো কোনো দলের মন্তব্য-মাংসে ঝোল কম হয়েছে এমন ইস্যু তৈরি করে শেষ মুহূর্তে ভেস্তে যেতে পারে কমিশনের সংস্কার সংলাপ। কারণ কমিশনের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে দলগুলোর প্রতি বারবার অনুরোধ জানানো হয়েছে নমনীয় হতে। তাই ঐকমত্যের ব্যর্থতার দায় শেষ পর্যন্ত কোনো দলই নিতে চাইবে না। আর এ কারণেই ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ঐকমত্য গঠনের। তখন দলীয় কাউন্সিলের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে মনে করছে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে ‘জুলাই সনদ’-এর অপেক্ষা না করে আগামী ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে জুলাই ঘোষণাপত্রের ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, অভ্যুত্থান ছাত্র-জনতা করেছে। এ ঘোষণাপত্র আমরা ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে সারা বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা শুনে ছাত্র-জনতার জুলাই ঘোষণাপত্র ও ইশতেহার পাঠ করব।
সব মিলিয়ে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে রাজনৈতির দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ অব্যাহত থাকলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করছে ঐকমত্য কমিশন। এই পর্বে মৌলিক সংস্কারের ২০টির মতো প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। এখন পর্যন্ত সাত দিনে আলোচনা হয়েছে ৯টি বিষয়ে। ঐকমত্য হয়েছে মাত্র দুটি বিষয়ে। আর কিছু ক্ষেত্রে আংশিক ঐকমত্য হয়েছে। তবে কোনো বিষয় এখনো আলোচনার টেবিল থেকে বাদ দেওয়া হয়নি।
এমতাবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয় বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, আবু সাঈদের শাহাদাতবার্ষিকীতে সবাই মিলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব। কিন্তু বাস্তবে সেটা কতটা সম্ভব হবে, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। আমরা খানিকটা শঙ্কিত। তার পরও জুলাই মাসের মধ্যে অবশ্যই এ প্রক্রিয়ার একটা পরিণতির দিকে যেতে হবে।
বিভিন্ন ইস্যুতে ঐকমত্য না হওয়ায় এরই মধ্যে দলগুলো একে অপরকে দোষারোপ করা শুরু করেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, এখনো মৌলিক সংস্কারের বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে আছি। বিএনপির আপত্তির জন্য সাংবিধানিক পদের নিয়োগ কমিটি গঠন করা যায়নি। মৌলিক সংস্কার বিএনপিসহ কয়েকটি দলের জন্য আটকে আছে বলেও জানান তিনি।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে প্রস্তাব রাখতে চাই, আপনারা প্লিজ, আগে প্রস্তাবগুলো সালাহউদ্দিন ভাই বা বিএনপির কাছে দেন। ওনারা কোনটাতে একমত, সেটা হাউসে (আলোচনায়) আনেন। আমরা সেটা নিয়ে আলোচনা করি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সব প্রস্তাবে একমত হতে বললে আলোচনার জন্য ডাকা হলো কেন, এমন প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য পোষণ হলে যেসব বিষয়ে দলসমূহ একমত হবে, সেই বিষয়গুলো এক করে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ সই হওয়ার কথা। এখানে যদি আমাদের বাধ্য করা হয় যে এসব বিষয়ে একমত হতেই হবে, সেটা তো সঠিক হলো না।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থাসমূহে নিয়োগের জন্য একটি স্থায়ী কমিটির গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে এ প্রস্তাবিত ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবিদ্ধ সংস্থার নিয়োগ কমিটি’ গঠনে এখনো বিএনপির আপত্তি রয়েছে। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, সংস্কার নিয়ে কিছু কিছু দল একেবারে নিজেদের অবস্থানে অনড়। যদি এভাবে চলতে থাকে, কেয়ামত পর্যন্ত কোনো ঐক্যের সম্ভাবনা দেখি না।
সব মিলিয়ে রাষ্ট্র সংস্কার ইস্যুতে জটিল হয়ে পড়ছে ঐকমত্য গঠন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ফরেন সার্ভিস একাডেমির প্রায় ১০ হাজার স্কয়ার ফুটের রুমে তৈরি আলোচনার টেবিল কতটা ফলপ্রসূ হবে কিংবা পরিণতি কী হবে এখন সেটাই দেখার প্রত্যাশায় রয়েছেন সবাই।