পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগের দিন গত বছরের ৪ আগস্টই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলোচনা করে তাকে নতুন সরকারের প্রধানের দায়িত্ব পালনের প্রস্তাব দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক ও জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের ৪৭তম সাক্ষী হিসেবে গতকাল দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি এ কথা বলেন।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ দেওয়া জবানবন্দিতে নাহিদ ইসলাম বলেন, প্রথমে ৬ আগস্ট সরকার পতনের এক দফা দাবিতে মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও পরে এক দিন এগিয়ে তা ৫ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। তিনি বলেন, জানতে পারি সরকার এই ৬ আগস্টের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ব্যর্থ করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। সমন্বয়কদের গুম বা হত্যা করা হতে পারে। তাই কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে নিয়ে আসা হয়। জবানবন্দিতে নাহিদ ইসলাম বন্ধুর বাসা থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া, ডিবি কার্যালয়ে নির্যাতন করারও বর্ণনা দেন। বিচার চান শেখ হাসিনাসহ দায়ীদের।
গতকাল তার জবানবন্দি শেষ হলে পরে তাকে জেরা শুরু করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. আমির হোসেন। তার এই জেরা শেষ না হওয়ায় আগামী রবিবার পরবর্তী দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। এদিন ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম, বি এম সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান প্রমুখ।
শেখ হাসিনার পাশাপাশি এ মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করে এ মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন। অন্যান্য দিনের মতো গতকালও তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
নন্দীপাড়ার বন্ধুর বাসা থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে দ্বিতীয় দিনের জবানবন্দিতে নাহিদ ইসলাম বলেন, রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে কয়েকজন ব্যক্তি সে বাসায় প্রবেশ করে আমাকে হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে, চোখে কালো কাপড় বেঁধে একটি প্রাইভেট কারে করে তুলে নিয়ে যায়। প্রাইভেট কারে উঠিয়েই আমাকে মারধর করতে থাকে। এরপর আমাকে একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাকে কিছুক্ষণ পর পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমার হাতে হ্যান্ডকাফ ও চোখে কালো কাপড় বেঁধে রাখত। আন্দোলনে কারা জড়িত, কেন আন্দোলন বন্ধ হচ্ছে না এসব জিজ্ঞাসা করত। তারা আমাকে শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে। নির্যাতনের ফলে আমি কয়েক দফা জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
ডিজিএফআই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে হাসপাতাল থেকে সেখানে নিয়ে যায় জানিয়ে নাহিদ জবানবন্দিতে বলেন, ডিজিএফআইয়ের কথামতো সংবাদ সম্মেলনে কথা না বলায় তারা আমাকে পুনরায় গুম করার হুমকি দেয়। ২৪ জুলাই সমন্বয়ক বাকের ও আসিফকে গুম অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। তখন তারা এই হাসপাতালে ভর্তি হয়। তখন থেকে হাসপাতালকে সম্পূর্ণ নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। হাসপাতালে ইন্টারনেট, টেলিফোন, পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমাদের মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়। আমাদের সঙ্গে কাউকে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় না। ডাক্তার ও নার্সদের আমাদের কোনো তথ্য প্রদানে সহযোগিতা না করতে তাদের ভয়ভীতি দেখানো হয়।
নাহিদ ইসলাম জবানবন্দিতে আরও বলেন, ডিবি অফিস থেকে আমাদের বলা হয়, আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার না করলে আরও নারী সমন্বয়কদের তুলে আনা হবে ও নির্যাতন করা হবে। একপর্যায়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য তাদের লিখিত একটি বক্তব্য আমাকে দিয়ে জোরপূর্বক পাঠ করিয়ে তা ভিডিও করে মিডিয়ায় প্রচার করা হয়। তারা আমাদের জানায়, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে আমাদের তুলে আনা, আটক রাখা ও নির্যাতন করা হয়েছে। একপর্যায়ে ডিবি প্রধান হারুন আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবটি আমরা প্রত্যাখ্যান করি এবং আমরণ অনশন শুরু করি।
জবানবন্দিতে নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, অন্যান্য সমন্বয়ক ও অন্যান্য ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র সংগঠন যেমন- ছাত্রদল, ছাত্রশিবির এবং বামপন্থি কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করি। এক দফায় আমরা ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাই। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করি। ৪ আগস্ট শাহবাগে অবস্থান ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করি। ওইদিন ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করি। সেদিন সরকার কারফিউ ঘোষণা করে এবং দেশব্যাপী ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়। নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা জানতে পারি, ৬ তারিখ মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ব্যর্থ করার উদ্দেশ্যে সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। সরকার মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেবে, আমাদের হত্যা বা গুম করা হতে পারে বলেও জানতে পারি। তাই আমরা আমাদের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করি। জবানবন্দিতে নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি সফল করার উদ্দেশ্যে সমন্বয়কদের পক্ষে মাহফুজ আলম অন্যান্য ছাত্র সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে লিয়াজোঁ করছিলেন। ৪ আগস্টই পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে আমরা নতুন সরকার গঠনের জন্য ড. ইউনূস স্যারের সঙ্গে আলোচনা করি। তাকে নতুন সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালনের প্রস্তাব দিই।
মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের চর্চা এখনো রয়েছে : জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, প্রত্যাশা অনুযায়ী মিডিয়ার সংস্কার হয়নি। ডিজিএফআই আগে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করত এখনো সেই চর্চা রয়েছে। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দেওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নাহিদ এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, মিডিয়া রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমি দায়িত্বে থাকাকালে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন করেছিলাম। তাদের দায়িত্ব ছিল পুরো বিষয়টি সংস্কার প্রস্তাব করে সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা। আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল যারা ফ্যাসিবাদের দোসর সংবাদমাধ্যমের কর্মী, তাদের বিচারের আওতায় আনা।