বন্যা পরিস্থিতি কোনো কোনো স্থানে বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। শরীয়তপুরে পদ্মা নদীতে ব্যাপক ভাঙনের খবর পাওয়া গেছে। নওগাঁর আত্রাই নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি পৌঁছেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থান থেকে বন্যাজনিত ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ পাওয়া গেছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
শরীয়তপুর : শরীয়তপুরে পদ্মা সেতুর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড রক্ষায় নির্মিত তীর রক্ষা বাঁধের ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা ভাঙনের শিকার হচ্ছে। গতকালও কয়েক শ পরিবারের ঘরবাড়ি নতুন করে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এনিয়ে দেড় মাসে প্রায় শতাধিক বসতবাড়ি ও স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বর্তমানেও ভাঙন আতঙ্কে বসতবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন পদ্মাপাড়ের মানুষ।
ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে জানা গেছে, শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা ইউনিয়নের জিরো পয়েন্ট এলাকায় পদ্মা নদীর ভয়াবহ ভাঙনে আলম খাঁর কান্দি জামে মসজিদের দ্বিতল ভবন চোখের পলকে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙনে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন মানুষ। অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে জীবন যাপন করছে অনেক পরিবার।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের শরীয়তপুর জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মাদ তারেক হাসান বলেন, ‘পদ্মার প্রবল স্রোতের কারণে ভাঙন ঠেকানো কঠিন হচ্ছে। আমরা আপদকালীনভাবে কাজ করছি। স্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে দ্রুত কাজ শুরু হবে।’ বর্তমানে ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে মাঝিরঘাট বাজারের ২০০টিরও বেশি দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং প্রায় ৬০০ পরিবার।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মিস তাহসিনা বেগম বলেন, ‘এলাকায় ভাঙন পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ ইতোমধ্যে শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া খাস জমি খুঁজে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত নদীভাঙনের শিকার ৭২টি খতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা করা হয়েছে। ভাঙনকবলিতদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২৯ জনকে ৬০ বান্ডেল টিন ও ১ লাখ ৮০ হাজার হাজার এবং ৪৬ জনকে জিআর নগদ অর্থ ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।
নওগাঁ : নওগাঁর মান্দায় বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে আত্রাই নদীর পানি। টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। এতে নদীর দুই তীরে অবস্থিত বেড়িবাঁধ ও বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের অন্তত ৩০টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২৪ ঘণ্টায় আত্রাই নদীর পানি ১০০ সেন্টিমিটার বেড়েছে। গতকাল দুপুর ১২টায় নদীর মান্দার জোতবাজার পয়েন্টে পানির উচ্চতা রেকর্ড করা হয় ১৪ মিটার। আর মাত্র ১ মিটার বাড়লেই উভয় তীরের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ চরম ঝুঁকিতে পড়বে। এ অবস্থায় আগাম প্রস্তুতি নিতে জরুরি সভা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। বেলা ১১টার দিকে মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে আয়োজিত সভায় সভাপতিত্ব করেন ইউএনও আখতার জাহান সাথী। সভায় ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে বাঁধ রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে বালুর বস্তা, বাঁশ ও প্রয়োজনীয় উপকরণ মজুত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি শুকনো খাবার মজুতের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। সভায় উপজেলার চকরামপুর, উত্তর চকরামপুর, কয়লাবাড়ী, জোকাহাট, দ্বারিয়াপুর, নুরুল্লাবাদ, পারনুরুল্লাবাদ ও তালপাতিলা এলাকার অন্তত ১০টি বেড়িবাঁধকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া বন্যানিয়ন্ত্রণ মূল বাঁধের লক্ষ্মীরামপুর, আয়াপুর, পাঁজরভাঙা, পলাশবাড়ী, মিঠাপুর, নিখিরাপাড়া ও গোয়ালমান্দাসহ অন্তত ২০টি পয়েন্টকে উচ্চঝুঁকির তালিকায় রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম নগরের দুই নম্বর গেট-অক্সিজেন সড়কের শীতল ঝরনা খালের ওপর নির্মিত স্টারশিপ ব্রিজটি টানা বর্ষণে সড়ক দেবে গিয়ে ধসে পড়েছে। গত বুধবার রাতে ভারী বর্ষণে পানির ঢলে ব্রিজটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গতকাল ভোরে ব্রিজের দুই পাশ থেকে মাটি সরে গিয়ে সড়ক দুই ভাগ হয়ে যায়। ফলে সড়কটির একপাশে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এরপর সরেজমিন দেখা গেছে, সড়কের এক পাশ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। ধীর গতিতে যান চলাচলের কারণে অক্সিজেন-২ নম্বর গেট সড়কের উভয়পাশে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। তাছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়গামী শাটল ও নাজিরহাট রুটে ট্রেন চলাচলও বিঘ্নিত হচ্ছে। চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, প্রবল বর্ষণে পানির ঢলে ব্রিজের নিচের মাটি সরে যাওয়ায় ব্রিজটি দেবে গেছে। এটি ৪৫ বছর আগের ২০ ফুটের একটি ব্রিজ। এখন এটাকে আমরা ৬০ ফুটের করব। জলাবদ্ধতা প্রকল্পটি চলার কারণে এখানকার অন্য কাজগুলো হয়নি। দ্রুতই ব্রিজটি করার উদ্যোগ নেব। আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, নগরীর আমবাগান স্টেশনে গতকাল সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় ২৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে এবং সকাল ৯টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৮১ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। পতেঙ্গা স্টেশনে একই সময়ে ৩২ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় আরও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের ঝুঁকি থাকায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এদিকে কয়েক ঘণ্টার ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। একই সঙ্গে আশ্রয়ণ প্রকল্পের শতাধিক ঘরবাড়ি কোমরপানিতে ডুবে গেছে। ফলে শিশু, বৃদ্ধসহ হাজারো মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। গবাদিপশু নিয়েও বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপজেলার ভাটিয়ারী ইউনিয়নের পাহাড়ঘেরা আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি। বুধবার রাত থেকেই ওই এলাকায় পানি ঢুকতে শুরু করে। এতে অনেক বাসিন্দা ঘরেই আটকা পড়েন। তাছাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের শতাধিক ঘর, উপজেলার কুমিরা, সৈয়দপুর, বারৈয়ারঢালা, মুরাদপুর এবং পৌর এলাকার বেশ কিছু জায়গা পানিতে তলিয়ে যায়। পানি থাকায় যান চলাচলও বন্ধ। স্রোতের কারণে স্থানীয় বাসিন্দারাও ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। ফলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করা হয়। সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাম বলেন, আমাদের সরকারি বাসভবনের নিচতলা পানিতে ডুবে যায় এবং উপজেলা পরিষদ চত্বরেও হাঁটুপানি। ভাটিয়ারীর আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ অনেক জায়গায় পানি উঠেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে আনা এবং শুকনা খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।