রাজধানীর ইস্কাটনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিয়াম) ফাউন্ডেশনে দগ্ধ হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়। ফায়ার সার্ভিস তাৎক্ষণিকভাবে জানায়, এসি বিস্ফোরণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি এ ঘটনা ঘটে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন ইউনিটের (এসআইঅ্যান্ডও) তিন মাসের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, এসি বিস্ফোরণে নয়, সেটি ছিল একটি হত্যাকাণ্ড। পেট্রোল ঢেলে বিয়ামের অফিসে শুধু নথিপত্র পুড়িয়ে দেওয়ার কারণেই হত্যাকাণ্ডটি ঘটে। আর নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলার কাজের জন্য চুক্তি হয় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। গতকাল রাজধানীর কল্যাণপুরে পিবিআই এসআইঅ্যান্ডও উত্তর কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব জানান সংস্থাটির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুর রহমান।
পিবিআই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) মাধ্যমে এ ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত এবং গ্রেপ্তার করে। তারা হলেন ঘটনার মাস্টারমাইন্ড বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম (৩৮) এবং তার ভাড়াটে সহযোগী আশরাফুল ইসলাম (৩৬)। ২৫ জুলাই কুড়িগ্রাম ও ঢাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুর রহমান বলেন, ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত ৩টা ২০ মিনিটে বিয়াম ভবনের ৫০৪ নম্বর কক্ষে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে ৫০৪ নম্বর কক্ষে রাখা সমিতির দলিলপত্র, নামজারিসংক্রান্ত কাগজপত্র, ব্যাংক হিসাব, চেকবই, জমি ক্রয়সংক্রান্ত চারটি চুক্তিপত্র, ইলেকট্রিক সামগ্রী, আসবাবপত্র কক্ষের এসিসহ অন্যান্য মালামাল পুড়ে ভস্মীভূত, চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। এ সময় অফিসসহায়ক আবদুল মালেক ঘটনাস্থলেই মারা যান এবং সমিতির সেক্রেটারির গাড়িচালক ফারুক গুরুতর আহত হন। পরে তাঁকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয় এবং সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনায় বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক অবসরপ্রাপ্ত সচিব মশিউর রহমান অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন। তিনি বলেন, হাতিরঝিল থানা পুলিশ দুই মাস মামলাটি তদন্ত করে। ৬ মে পিবিআই এসআইঅ্যান্ডও (উত্তর) মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে। পিবিআইয়ের বিশেষ টিম মামলার ঘটনার তারিখ ও সময় এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণে জানতে পারে ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত আড়াইটায় মাথায় মাস্কিং ক্যাপ, মুখে মাস্ক, হাতে হ্যান্ড গ্লাভস, পায়ে স্যান্ডেল পরা ৩০-৩৫ বছর বয়সি এক যুবক বিয়াম ভবন মাঠের পশ্চিম দিক থেকে এসে সিঁড়ি দিয়ে পঞ্চম তলায় চলে যান এবং সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দেন। পিবিআইয়ের টিম আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে আসামির ছবি শনাক্ত করে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পিবিআইয়ের একাধিক টিম আত্মগোপনে থাকা আশরাফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আশরাফুল ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন এবং তার দেওয়া তথ্যে বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামকে ভাটারা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আশরাফুল পিবিআইকে জানান, জাহিদুল ইসলাম তার পূর্বপরিচিত এবং এলাকার ভাই। জাহিদুল তাকে গত বছরের শুরুতে ঢাকায় এনে মগবাজার থ্রি-স্টার হোটেলে একটানা পাঁচ-ছয় মাস রাখেন। জাহিদুল ইসলামের সূত্র ধরে তিনি প্রায়ই বিয়ামে যাতায়াত করতেন এবং ওই অফিসের কাজে কয়েকজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয়। জাহিদুল সমিতির মূল নথিপত্র স্থায়ীভাবে ধ্বংসের জন্য আশরাফুল, অফিসসহায়ক মালেক ও গাড়িচালক ফারুক মিলে পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ শেষে তাদের ১০-১২ লাখ টাকা দেওয়ার মৌখিক চুক্তি হয়। জাহিদুল পরিকল্পনা মোতাবেক একদিন আশরাফুলকে কিছু টাকা দিয়ে বিয়ামের পঞ্চম তলার সিসি ক্যামেরা বন্ধ করতে বলেন। জাহিদের দেওয়া টাকায় আশরাফুল মাস্ক, মাস্কিং ক্যাপ, হ্যান্ড গ্লাভস ও ফুল স্লিপ শার্ট কেনেন। ঘটনার দিন আশরাফুল মাথায় মাস্কিং ক্যাপ, মুখে মাস্ক এবং হ্যান্ড গ্লাভস পরে বিয়াম ভবনের পঞ্চম তলায় উঠে ক্যামেরা বন্ধ করে দেন। ক্যামেরা বন্ধ করার পর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অফিসসহায়ক মালেক ও ড্রাইভার ফারুক চতুর্থ তলার ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করেন। তখন আশরাফুল দরজার পাশে সিঁড়ির কোনায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করে গাড়িচালক মালেক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন। আশরাফুল পঞ্চম তলা থেকে তৃতীয় তলায় নামতেই বিকট বিস্ফোরণের শব্দ হয়। ঘটনাস্থলেই অফিসসহায়ক মালেক মারা যান। জাহিদ গাড়ি নিয়ে আশরাফুলের সহযোগিতায় গুরুতর আহত অবস্থায় ড্রাইভার ফারুককে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করান। পরে জাহিদের কথামতো আশরাফুল পরদিন রংপুর চলে যান। ২৬ জুলাই জাহিদুল এবং আশরাফুলকে আদালতে সোপর্দ করা হলে তারা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।