বরিশালের বাকেরগঞ্জে দুধল আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. বশির আহম্মদ শিকদার (ইনডেক্স নং ২০৭১৮২) ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বরে অবসরে যান। গত ২০২১ সালের জানুয়ারিতে অবসর সুবিধা পেতে আবেদন করেন তিনি। এরপর সাড়ে চার বছর পার হলেও তিনি অবসর সুবিধার টাকা পাননি। শেষ বয়সে এসে নানা রোগে আক্রান্ত বশির আহম্মদ বছরের পর বছর ধরে এই টাকার অপেক্ষায় রয়েছেন।
অবসর সুবিধা বোর্ডের টাকার জন্য ২০২১ সালের জুনে আবেদন করেন রংপুরের একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. মমতাজুল ইসলাম (ইনডেক্স নং ০০১৪৪১)। এরপর চার বছর পার হলেও তিনি প্রাপ্য টাকা পাননি।
শুধু অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বশির আহম্মদ শিকদার আর মমতাজুল ইসলামই নন, কল্যাণ ট্রাস্ট আর অবসরের টাকা না পেয়ে নানা সংকটে পড়েছেন প্রায় ৯৪ হাজার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারি। তাদের আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন বলে জানা গেছে।
অবসরে যাওয়ার পর অনেকে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন, কেউ-বা মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন নানা সংকটের মধ্য দিয়ে। চাকরিজীবন শেষে শিক্ষকরা অবসরের টাকার অপেক্ষায় দিন গুণলেও তাদের দুর্ভোগ যেন দেখার কেউ নেই। প্রতিদিনই রাজধানীর পলাশী ব্যানবেইস ভবনে কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধার টাকা পেতে ভিড় করছেন অসহায় শিক্ষক-কর্মচারিরা।
সম্প্রতি ব্যানবেইস ভবনের নিচে কথা হয় রাজধানীর তুরাগের কামারপাড়া স্কুল এন্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক মো. মহসীনের (ইনডেক্স নং ২৭৪৫৭৬) সঙ্গে। তিনি তার অসুস্থ্য মেয়ে মোহসিনা আফরোজ মিশুকে (বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী) নিয়ে কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর বোর্ডের সুবিধার টাকার খবর নিতে এসেছিলেন। গত ২০২২ সালের এপ্রিলে অবসরে যাওয়া এ শিক্ষক অর্থাভাবে মেয়ের চিকিৎসা করতে পারছেন না। তার অসহায়ত্বের কথা কর্মকর্তাদের জানালেও খুব শিগগিরই টাকা পাওয়ার আশা পাননি তিনি।
তথ্যমতে, শিক্ষক-কর্মচারিরা চাকরিজীবনে মূল বেতনের ৬ শতাংশ অবসর সুবিধা বোর্ডে ও ৪ শতাংশ কল্যাণ ট্রাস্টে জমা দিয়ে থাকেন। তাদের জমাকৃত অর্থে সরকার একটি নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে অবসরের পর এই সুবিধার অর্থ দেন শিক্ষক-কর্মচারীদের। বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডে খবর নিয়ে জানা গেছে, দুই শাখায় মোট ৯৪ হাজার আবেদন অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী কল্যান ট্রাস্টে রয়েছে ৪৯ হাজার আবেদন। আর অবসর সুবিধা বোর্ডে অনিষ্পন্ন আবেদন রয়েছে ৪৫ হাজার।
কল্যাণ ট্রাস্ট সূত্র জানায়, ৪৯ হাজার শিক্ষকের আবেদন নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজন ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বাজেটে এই খাতে কোনো অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। গত বাজেটে মাত্র ২০০ কোটি টাকা বন্ড দেয়া হয়েছে কল্যাণ ফান্ডে, যার শুধু ইন্টারেস্টের অংশ ব্যবহার করা যাবে। কল্যাণ ট্রাস্টের অধীণে ২০২২ সালের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চের আবেদনের টাকা ইতোমধ্যে ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এপ্রিলের আবেদনের অর্থ ইতোমধ্যে ইএফটির মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। এরপরের আবেদনগুলো অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়ে গেছে।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব (রুটিন দায়িত্ব) ড. শরিফা নাছরীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিক্ষক-কর্মচারিদের কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা দিতে আমাদের সদিচ্ছার কমতি নেই। কিন্তু বাজেট বরাদ্দ না থাকা ও ফান্ডে প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকায় শিক্ষক-কর্মচারিদের যথাসময়ে এই সুবিধা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এই শাখার অধীণে সর্বশেষ ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে। অনিষ্পন্ন রয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার আবেদন। এসব আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। ফান্ডে অর্থ সঙ্কটের কারণে শিক্ষকদের সময়মতো অবসর সুবিধা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান সদস্য সচিব (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক মো. জাফর আহম্মদ। তিনি জানান, সরকার গত অর্থবছরে ২০০ কোটি টাকা বন্ড দিয়েছে। শুধুমাত্র এর ব্যাংক ইন্টারেস্ট আমরা ব্যবহার করতে পারছি। এককালিন বড় অংকের টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারিদের দুর্ভোগ লাঘব করা সম্ভব হবে। জানা গেছে, প্রায় এক মাস ধরে সার্ভার আপগ্রেডেশনের কাজ চলছে অবসর সুবিধা বোর্ডের। এতেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারিকে।