ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেন, ‘সমাজে অন্যায় তখনই বিস্তার লাভ করবে যখন সৎ লোকেরা নীরব থাকবে।’ চোখের সামনে অন্যায় কর্মকাণ্ড দেখে চুপ থাকা মুমিনের লক্ষণ নয়। মুমিনের শুধু ভালো কাজের আদেশের মধ্যেই শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় বহন করে না, অন্যায় ও অসৎ কাজে নিষেধ করার মধ্যেও শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় বহন করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, মানুষের কল্যাণে তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অন্যায় কাজে বাধা প্রদান করবে।’ (সুরা আল ইমরান : ১১০)।
অন্যায় চোখের সামনে ঘটলে অবশ্যই প্রতিবাদ করতে হবে। ঝামেলা হবে এমনটি মনে করে দেখে না দেখার মতো অন্য পথে হেঁটে চলে যাওয়া কিংবা ছবি ও ভিডিও করাতেই সমাধান নয়। অন্যায়কারী অন্যায় করেই চলছে, আমরা মানুষ হয়ে নিজেকে প্রিয় নবীর প্রেমিক মনে করে অন্যায় দেখেই যাচ্ছি। যার সঙ্গে অন্যায় জুলুম হচ্ছে সে অসহায় হওয়ায় তার পক্ষে অবস্থান না নিয়ে ভয়ে অন্যায়কারীকে কোনোরূপ বাধা প্রদান করি না। সবাই এড়িয়ে যাই বা তামাশা দেখি। মনে রাখতে হবে, একদিন আমার ওপরেই অন্যায়ভাবে জুলুম-নির্যাতন হলে আমার সেই বিপদের মুহূর্তে কাউকে কিন্তু পাশে পাব না। যেহেতু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অন্যের বিপদে এগিয়ে আসা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই সময় অনুযায়ী শক্তভাবে একাকী সম্ভব না হলে সম্মিলিতভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। অন্যায়কারীকে প্রতিরোধ না করলে অন্যায়কারী ভাববে আমাকে সবাই ভয় পায়, কেউ কিছুই বলে না এই ভেবে তার সাহস বৃদ্ধি পেতেই থাকবে এবং দিনদিন বড় ধরনের অন্যায় ও জুলুম করার সুযোগ পেয়ে যাবে। আমাদের চুপ থাকার ফলে গোটা সমাজ ও এলাকায় এবং দেশের ক্ষতি হবে। হজরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যদি মানুষ কোনো মন্দ কাজ দেখে এবং তা প্রতিরোধ না করে, তবে আল্লাহ দ্রুত তাদের সবাইকে শাস্তির সম্মুখীন করবেন।’ (তিরমিজি শরিফ)।
মুমিন তাকওয়াবান ব্যক্তিরাই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস রাখে। মৃত্যুর ভয় নেই, হৃদয়ে আল্লাহর ভয় বিদ্যমান থাকলেই প্রতিবাদ সম্ভব। এজন্য তাকওয়াবান হওয়া জরুরি। প্রতিবাদের ধরন দেখেই নিজের ইমানের স্তরকে পরীক্ষা করতে পারি। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন অন্যায় হতে দেখবে তখন সে যেন তা শক্তি দিয়ে প্রতিহত করে। যদি শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা না থাকে তাহলে যেন মুখের ভাষায় প্রতিবাদ করে। তা-ও যদি না পারে তাহলে যেন ব্যক্তি অন্তর থেকে সে কাজকে ঘৃণা করে। আর এটিই ইমানের দুর্বলতম স্তর।’ (সহিহ মুসলিম শরিফ)।
অন্যায়কারী নিঃসন্দেহে একদিন পরাজিত হবেই হবে। যুগে যুগে পাহাড় কেটে বাড়ি নির্মাণ করা শক্তিশালী জাতিরাই ধ্বংস হয়েছিল। আল্লাহ ক্ষমাশীল, তবে ছেড়ে দেন না। যাদের দুর্বল-অসহায় ও সাধারণ মানুষ ভেবে জুলুম-অত্যাচার করা হয়েছিল তারাই এই পৃথিবীর বুকে সম্মান ও মর্যাদার আসনে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। যা আমরা আগের নবীদের ইতিহাস থেকে জানতে পারি। অন্যায়কারী জালেমের জুলুম ক্ষণস্থায়ী, তবে শাস্তি ভয়াবহ। অন্যায়কারীদের ব্যাপারে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই যারা মানুষকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়, আল্লাহতায়ালা তাদের শাস্তি প্রদান করবেন।’ (মুসলিম শরিফ)।
প্রিয় পাঠক, অন্যায়কারীদের সঙ্গে আপস নয়। অন্যায়কারীকে সহায়তা করাও অন্যায়। আমি অন্যের সঙ্গে যে ব্যবহার করছি তা যদি অন্যরা আমার সঙ্গে করত তখন কেমন লাগত এই ভাবনা সর্বদা হৃদয়ে পোষণ করতে হবে। সর্বদা ন্যায়ের পক্ষে থাকব। অন্যায় করব না করতেও দেব না। প্রতিবাদ করে প্রতিরোধ করব। এটাই আমাদের ইমানি দায়িত্ব। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, দানসদকা ও হাতে তাসবিহ পাঠের সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করে নির্মূল করা জরুরি। কেননা মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কেও জিজ্ঞাসিত করবেন। ভয়কে জয় করতেই হবে। মুমিন মৃত্যুবরণ করে একবার। কেননা এই জীবন এই মৃত্যু সবকিছুই তো সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহর জন্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলুন, আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহরই জন্য।’ (সুরা আল আন’আম : ১৬২)
লেখক : ইসলামি গবেষক
বিডি প্রতিদিন/এমআই