গত শুক্রবার (১১ জুলাই) ছিল স্রেব্রেনিচা গণহত্যার ৩০ বছর পূর্তি। স্রেব্রেনিচার পোটোচারি সমাধিক্ষেত্র ও স্মৃতিকেন্দ্রে সমবেত হয়েছিল কয়েক হাজার বসনিয়ান মুসলিম। সার্ব বাহিনীর গণহত্যার শিকার আত্মীয়দের প্রতি সম্মান জানাতে তারা সেখানে সমবেত হয়েছিল। ১৯৯৫ সালের ১১-২২ জুলাই পর্যন্ত সার্ব বাহিনী আট হাজার মুসলিম পুরুষ, যুবক ও কিশোরকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
হত্যার পর তাদের গণকবর দেওয়া হয় এবং অনেকের লাশ গুম করা হয়। পোটোচারি সমাধিক্ষেত্রে গণহত্যার শিকার শহীদ মুসলিম পুরুষদের লাশ সমাহিত করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজার শহীদের লাশ বা তাদের দেহাংশ এখানে দাফন করা হয়েছে। শুক্রবার তাদের সঙ্গে যোগ হয় নতুন সাতজন।
গণহত্যার পরবর্তী কয়েক দশকে ফরেনসিক বিজ্ঞানী এবং International Commission on Missing Persons (ICMP) নিহতদের দেহাবশেষ শনাক্ত ও খুঁজে বের করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এখনো এক হাজারের বেশি নিখোঁজ আছে।
গত শুক্রবার যাদের দাফন করা হয় তাদের একজন ছিলেন হাসিব ওমরাভিচ। তাঁকে ৩৪ বছর বয়সে শহীদ করা হয়। ১৯৯৮ সালে একটি গণকবরে তাঁর লাশের সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁর পরিবার এত দিন দাফন করেনি এই আশায় যে হয়তো তাঁর দেহের অবশিষ্ট অংশ পাওয়া যাবে।
২০১০ সালের অক্টোবর মাসে সুলজিচি গ্রামে শহীদ সেনাদিজ আভদিচের দেহাবশেষ পাওয়া যায়। সুলজিচি গ্রামটি সার্ব বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়েছিল। সেনাদিজ আভদিচকে ১১ জুলাই ১৯৯৫ শহীদ করা হয়েছিল।
তাঁর ভাই জেজাদ আভদিচ বলেন, যখন প্রথম সংবাদ এলো তখন আমি কিছুতেই আমার মা-বাবাকে বিষয়টি জানাতে চাইনি। কেননা তা ছিল অত্যন্ত কঠিন সংবাদ। আমরা তাঁর পূর্ণ দেহ পাইনি, আমরা পেয়েছি কেবল কয়েকটি হাড় ও মাথার খুলি। আভদিচ পরিবারের মতো অনেকেই দশকের পর দশক ধরে কয়েক টুকরা হাড়ের জন্য অপেক্ষা করছে, যেন তারা প্রিয়জনের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে। অনেকেই তাদের প্রিয়জনের মাত্র কয়েক টুকরা হাড়ই দাফন করেছে।
স্রেব্রেনিচা গণহত্যা ছিল সার্ব-বসনিয়া যুদ্ধের চূড়ান্ত ও নৃশংসতম পর্ব। যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যাওয়ার পর সার্বরা দেশের অন্য দুটি জনগোষ্ঠী ক্রোট ও বসনিয়ান মুসলিমদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনে লিপ্ত হয়। ১১ জুলাই ১৯৯৫ সার্ব বাহিনী স্রেব্রেনিচা দখল করে, যা ছিল জাতিসংঘ ঘোষিত নিরাপদ অঞ্চল এবং সেখানে হাজার হাজার বসনিয়ান মুসলমান আশ্রয় নিয়েছিল। সার্ব বাহিনী সেখানে আট হাজার বসনিয়ান মুসলিম পুরুষ ও বালককে তাদের পরিবার থেকে পৃথক করে এবং তাদের ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে। এ সময় মুসলিম পুরুষ ও বালকদের অনেকেই বনের ভেতর দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের ধাওয়া করে হত্যা করা হয়। গণহত্যার পাশাপাশি বহু মুসলিম নারী ও কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়।
গত শুক্রবার শহীদ পরিবারের সদস্যরা সমবেত হয়। তারা শহীদদের জন্য নামাজ পড়ে এবং দোয়া করে। নামাজের পর বসনিয়ার পতাকায় মোড়ানো শহীদদের দেহাবশেষ নিয়ে আসা হয় এবং তাদের সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠে দাফন করা হয়।
৬৬ বছর বয়সী ফিকরেরা তুহলজাকোভিচ প্রতিবছর এই স্মরণ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। কিন্তু এ বছর তাঁর জন্য কিছুটা ভিন্ন। কেননা এ বছর দাফন করা সাতজনের ভেতর তাঁর এক চাচাতো ভাইও আছেন। তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে বলেন, আমি যত দিন বেঁচে আছি এখানে আসব এবং আমার চাচাতো ভাইকে মনে রাখব। আমি বিশ্বাস করি, সব শহীদকে স্মরণ রাখা হবে।
২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) ঘোষণা করে যে স্রেব্রেনিচা এবং তার আশপাশের এলাকায় সংঘটিত ঘটনাগুলো ছিল গণহত্যা। বসনিয়ান সার্ব নেতা রাদোভান কারাদিচ ও রাটকো ম্লাদিচকে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ও বলকান অঞ্চলের বিভিন্ন আদালত প্রায় ৫০ জন বসনিয়ান সার্ব যুদ্ধকালীন কর্মকর্তাকে ৭০০ বছরেরও বেশি কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। তবে এখনো অনেক অভিযুক্ত ব্যক্তি অদণ্ডিত রয়ে গেছেন।
এমির সিচা ইসলামিক রিলিফের বসনিয়া কান্ট্রি ডিরেক্টর। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো স্রেব্রেনিচার মতো হত্যাযজ্ঞ ঠেকাতে যথেষ্ট কিছু করেনি। বর্তমানে গাজায় যে ঘটনা ঘটছে, সেটিও তেমনই একটি বর্বরতা। আজ আমরা গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের দাফন করছি, আর আজও গাজায় গণহত্যা চলছে।
তথ্য সূত্র- আল জাজিরা অবলম্বনে।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ