জান্নাত হলো এমন এক চিরস্থায়ী সুখের আবাস, যা আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন। দুনিয়ার জীবনে যারা ঈমানদার হয়ে সৎকাজ করে, কষ্ট সহ্য করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবন পরিচালনা করে, তাদের জন্য প্রতিদান স্বরূপ জান্নাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জান্নাত আল্লাহ তাআলার প্রতিশ্রুত পুরস্কার, যেখানে মুমিনরা চিরস্থায়ী শান্তি, সুখ ও আনন্দ উপভোগ করবেন। কোরআন ও সহিহ হাদিসে জান্নাতের সৌন্দর্য, শান্তি ও বিলাসিতার অনেক বর্ণনা রয়েছে।
আবার কোরআন ও হাদিসের আলোকে জান্নাতে এমন কিছু জিনিস বা বিষয় থাকবে না, যা দুনিয়ার নেতিবাচক বা অপ্রীতিকর দিকগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত। নিচে জান্নাতে যেসব জিনিস বা বিষয় থাকবে না, তা বর্ণনা করা হলো-
কোনো দুঃখ-কষ্ট বা শোক: জান্নাতে কোনো ধরনের মানসিক বা শারীরিক কষ্ট থাকবে না। তাই জান্নাতে কান্না, হতাশা, উদ্বেগ বা মানসিক অশান্তি থাকবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের কোনো ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিত হবে না।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৬২)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা সেখানে কোনো কষ্ট বা ক্লান্তি অনুভব করবে না।’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৪৮)
মৃত্যু বা অস্তিত্বের সমাপ্তি: জান্নাতে মৃত্যু থাকবে না; জান্নাতিরা চিরকাল বেঁচে থাকবেন। তাই দুনিয়ার মতো জান্নাতে মৃত্যুর ভয় বা অস্তিত্ব হারানোর চিন্তা থাকবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা সেখানে চিরকাল থাকবে।’ (সুরা : বাইয়িনা, আয়াত : ৮)
হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাতে একটি ঘোষক ঘোষণা করবে, হে জান্নাতিরা, তোমরা চিরকাল বেঁচে থাকবে, কখনো মরবে না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৮৩৭)
রোগ-ব্যাধি বা শারীরিক দুর্বলতা : জান্নাতে কোনো রোগ, ব্যথা বা শারীরিক দুর্বলতা থাকবে না। জান্নাতে মাথা ব্যথা, জ্বর, বার্ধক্য বা কোনো শারীরিক অক্ষমতা থাকবে না। হাদিসে এসেছে, ‘জান্নাতিরা কখনো অসুস্থ হবে না, বৃদ্ধ হবে না, এবং চিরকাল তরুণ থাকবে।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৫৪৫)
মল-মূত্র বা অপবিত্রতা : জান্নাতে মানুষের শরীর থেকে কোনো অপবিত্র জিনিস (যেমন—মল, মূত্র, ঘাম) বের হবে না।
জান্নাতে কোনো নোংরা বা অপ্রীতিকর গন্ধ থাকবে না; সব কিছু পবিত্র ও সুগন্ধময় হবে। হাদিসে এসেছে, ‘জান্নাতিরা যা খাবে, তা তাদের শরীর থেকে মেশকের মতো সুগন্ধি হিসেবে বের হবে।’
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৮৩৫)
হিংসা, শত্রুতা বা মনোমালিন্য : জান্নাতিরা একে অপরের প্রতি হিংসা বা শত্রুতা পোষণ করবে না। জান্নাতে কোনো মানুষের মধ্যে বিরোধ, কলহ বা মনোমালিন্য থাকবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমরা তাদের হৃদয় থেকে সব বিদ্বেষ দূর করে দেব, তারা ভাইয়ের মতো মুখোমুখি বসবে।’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৪৭)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রথম যে দল জান্নাতে প্রবেশ করবে, তারা পূর্ণিমা রাতের চাঁদের মতো উজ্জ্বল আকৃতি ধারণ করে প্রবেশ করবে আর তাদের পর যারা প্রবেশ করবে তারা অতি উজ্জ্বল তারকার মতো রূপ ধারণ করবে। তাদের অন্তরগুলো এক ব্যক্তির অন্তরের মতো হয়ে থাকবে। তাদের মধ্যে কোনোরূপ মতভেদ থাকবে না আর পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩২৪৬)
ক্লান্তি বা পরিশ্রম : জান্নাতে কোনো ক্লান্তি বা শ্রম থাকবে না। দুনিয়ার মতো কাজের চাপ, শ্রম, বা ক্লান্তি জান্নাতে থাকবে না। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা সেখানে কোনো পরিশ্রম অনুভব করবে না।’ (সুরা : ফাতির, আয়াত : ৩৫)
অপূর্ণতা বা অভাব : জান্নাতে কোনো চাহিদা অপূর্ণ থাকবে না। দুনিয়ার মতো অভাব, ক্ষুধা, বা অপূর্ণ ইচ্ছা জান্নাতে থাকবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা যা চাইবে, তাই পাবে, এবং আমার কাছে আরো বেশি আছে।’ (সুরা : কাফ, আয়াত : ৩৫)
হাদিসে এসেছে, ‘জান্নাতিরা যা চাইবে, তা তৎক্ষণাৎ পাবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৫০১)
অশ্লীলতা বা অসৌজন্য : জান্নাতে কোনো অশ্লীল কথা বা আচরণ থাকবে না। জান্নাতে গালাগাল, অশ্লীলতা, বা অসৌজন্যমূলক কথাবার্তা থাকবে না। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা সেখানে কোনো অশ্লীল বা মন্দ কথা শুনবে না, শুধু শান্তির কথা শুনবে।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ৬২)
গোপনীয়তার অভাব: জান্নাতে কেউ কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। সবাই নিজ নিজ গোপনীয়তা ও সম্মান উপভোগ করবে। দুনিয়ার মতো গোপনীয়তা লঙ্ঘন বা হস্তক্ষেপ জান্নাতে থাকবে না।
হাদিসে এসেছে, ‘জান্নাতিরা তাদের প্রাসাদে থাকবে, একে অপরের সঙ্গে শান্তিতে থাকবে।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৫৫৯)
শয়তান বা প্রলোভন : জান্নাতে শয়তান বা তার প্ররোচনা থাকবে না। দুনিয়ার মতো শয়তানের ওয়াসওয়াসা বা পাপের প্রলোভন জান্নাতে থাকবে না। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘শয়তান তাদের কাছে পৌঁছতে পারবে না।’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৪২)
গরম বা ঠাণ্ডার অস্বস্তি : জান্নাতে কোনো চরম আবহাওয়ার অস্বস্তি থাকবে না। জান্নাতে গরম, ঠাণ্ডা বা অস্বস্তিকর পরিবেশ থাকবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা সেখানে ছায়ার মধ্যে থাকবে এবং তাদের জন্য ফলমূল ও পানীয় থাকবে।’ (সুরা : মুরসালাত, আয়াত : ৪১-৪৩)
নিষিদ্ধ খাদ্য বা পানীয় : জান্নাতে হারাম খাদ্য বা পানীয় (যেমন—মদ, শূকরের মাংস) থাকবে না। তবে জান্নাতে হালাল ও পবিত্র পানীয় থাকবে, যা মদের মতো মনে হলেও হারাম নয়। জান্নাতে সব খাদ্য ও পানীয় পবিত্র, সুস্বাদু এবং হালাল হবে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা সেখানে পবিত্র পানীয় পান করবে, যা তাদের মাতাল করবে না।’ (সুরা : সাফফাত, আয়াত : ৪৫-৪৭)
অন্যায় বা জুলুম : জান্নাতে কোনো অন্যায়, জুলুম বা অবিচার থাকবে না। দুনিয়ার মতো শোষণ, অত্যাচার বা অবিচার জান্নাতে থাকবে না। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘জান্নাতে কোনো অবিচার করা হবে না।’ (সুরা : মারয়াম, আয়াত : ৬০)
জান্নাত এমন একটি স্থান, যেখানে শুধু সুখ, শান্তি ও পবিত্রতা থাকবে। হাদিসে এসেছে : ‘জান্নাতে এমন জিনিস আছে, যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি এবং কোনো মানুষের হূদয় তা কল্পনা করেনি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩২৪৪)
জান্নাতে সব কিছু পরিপূর্ণ, পবিত্র এবং আল্লাহ তাআলার রহমতের প্রতিফলন হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের জান্নাতের জন্য কবুল করুন। আমিন।