ইসলামী শরিয়তের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ও নীতি হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং মানুষের মধ্যে জুলুম-অন্যায় প্রতিরোধ করা। ইসলামে এমনভাবে ন্যায়ের মানদণ্ড বজায় রাখা হয় যে সমাজ ও ব্যক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা হয়। এতে সমাজের অধিকারকে অতিরিক্ত মহিমান্বিত করা হয় না, আবার ব্যক্তির অধিকারকেও বাড়িয়ে তোলা হয় না। এটি সেই ভারসাম্যের তত্ত্ব অনুযায়ী পরিচালিত হয়, যা ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্য রাখে।
ইসলাম সমাজের নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা ও শান্তি রক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে।
আল্লাহ তাআলা মিথ্যা সাক্ষ্য হারাম করেছেন এবং এটিকে অন্যতম বড় গুনাহ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এই প্রবন্ধে আমরা মিথ্যা সাক্ষীর ধারণা, এর ভয়াবহতা এবং ইহকাল ও পরকালে এর পরিণতি বিশ্লেষণ করব।
মিথ্যা সাক্ষ্যের সংজ্ঞা
মিথ্যা সাক্ষ্য বলতে এমন সাক্ষ্য বা বক্তব্যকে বোঝায়, যা সত্যের বিপরীত এবং ইচ্ছাকৃতভাবে দেওয়া হয়, যার ফলে কারো অধিকার ক্ষুণ্ন হয়, ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হয় বা অন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা সাক্ষ্য গোপন কোরো না, আর যে সাক্ষ্য গোপন করে বা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, তার হৃদয় অপরাধী।’
(সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮৩)
মিথ্যা সাক্ষ্য কবিরা গুনাহ
মিথ্যা সাক্ষ্য সমাজ ও ব্যক্তির জন্য বহুমাত্রিক ক্ষতির কারণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) মিথ্যা সাক্ষ্যকে গুরুতর পাপের মধ্যে গণ্য করেছেন। একটি হাদিসে তিনি বলেছেন, তোমরা কি আমাকে সবচেয়ে বড় পাপ সম্পর্কে বলব? তা হলো, আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা, মা-বাবার অবাধ্যতা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।
তিনি এই কথা বলার সময় বিশ্রামরত অবস্থায় ছিলেন, কিন্তু উঠে বসে গেলেন এবং বারবার এটি পুনরাবৃত্তি করতে লাগলেন।
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৬৫৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৮৭)
এই হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) মিথ্যা সাক্ষ্যের ভয়াবহতা বোঝাতে শুয়ে থাকা অবস্থা থেকে উঠে বসেন এবং বারবার এর গুরুত্ব তুলে ধরেন। এটি ইঙ্গিত করে যে মিথ্যা সাক্ষ্য শুধু দুনিয়ায় ন্যায়বিচার ধ্বংস করে না, বরং পরকালে জাহান্নামের শাস্তির কারণ হয়।
মিথ্যা সাক্ষীর বিচার কার্যকর নয়
অনেক সময় মানুষ মনে করে যে কোনো বিষয় যদি আদালতের মাধ্যমে তারা নিজেদের অনুকূলে পায়, অথচ বাস্তবে তা তার হক নয় বরং অন্যের হক, তখন তারা মনে করে, এই আদালতের রায় তাদের আল্লাহর কাছে দায়মুক্ত করে ফেলেছে বা এই রায়ের মাধ্যমে সে তার ভাইয়ের হককে নিজের জন্য হালাল করে নিয়েছে। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা মোকদ্দমা নিয়ে আমার কাছে আগমন করে থাক এবং তোমাদের একজন অন্যজন অপেক্ষা যুক্তিতর্কে অধিক বাকপটু হয়ে থাকে।
নিজ দাবি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করো। আমি কথা শুনে তার অনুকূলে রায় প্রদান করি। সুতরাং এতে যদি তার ভাইয়ের হকের কিছু তাকে প্রদান করি (বাস্তবে হয়তো এতে তার কোনো অধিকারই নেই) তখন তার কর্তব্য হবে তা গ্রহণ না করা। কেননা, এতে যেন আমি তাকে জাহান্নামের এক খণ্ড অগ্নি প্রদান করলাম।
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৩২৪)
ন্যায়বিচারের ধ্বংস
মিথ্যা সাক্ষ্য ন্যায়বিচারের ভিত্তি ক্ষুণ্ন করে। আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে নিরপরাধ ব্যক্তি শাস্তি পেতে পারে এবং অপরাধী মুক্তি পেতে পারে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা মিথ্যা সাক্ষ্য থেকে দূরে থাক।’
(সুরা : হজ, আয়াত : ৩০)
সামাজিক অবিশ্বাস ও বিশৃঙ্খলা
মিথ্যা সাক্ষ্য সমাজে অবিশ্বাস ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। যখন মানুষ সাক্ষ্যের ওপর ভরসা করতে পারে না, তখন সমাজে বিশ্বাসের ভিত্তি ভেঙে পড়ে। হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মিথ্যা সাক্ষ্য ৭০টি গুরুতর পাপের সমান।’
(ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৩৬৯)
আল্লাহর আদেশের লঙ্ঘন
মিথ্যা সাক্ষ্য আল্লাহর সরাসরি নিষেধাজ্ঞার লঙ্ঘন। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা সত্যের সঙ্গে দাঁড়াও, যদিও তা তোমার নিজের বা তোমার মা-বাবার বিরুদ্ধে যায়।’
(সুরা : নিসা, আয়াত : ১৩৫)
অন্যের অধিকার হরণ
মিথ্যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে কারো সম্পত্তি, সম্মান, বা জীবনের অধিকার হরণ করা হয়। এটি গুরুতর অপরাধ। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে কারো অধিকার হরণ করে, তার জন্য জাহান্নামের আগুন প্রস্তুত।’
(মুসনাদ আহমদ, হাদিস : ২৭৬৮৫)
মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার পরিণতি
মিথ্যা সাক্ষীর পরিণতি ইহকাল ও পরকালে ভয়াবহ। মিথ্যা সাক্ষী সমাজে অবমাননা ও অবিশ্বাসের কারণ হয়। এমন ব্যক্তির সাক্ষ্য ভবিষ্যতে গ্রহণযোগ্য হয় না। মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে অন্যের ক্ষতি করলে অন্তরে অশান্তি ও অপরাধবোধ জন্মায়। পবিত্র কোরআনে মিথ্যা সাক্ষীদের জন্য কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘(পক্ষান্তরে) যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ও নিজেদের কসমের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে, আখিরাতে তাদের কোনো অংশ নেই। আর আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে (সদয় দৃষ্টিতে) তাকাবেন না এবং তাদের পবিত্র করবেন না। তাদের জন্য থাকবে কেবল যন্ত্রণাময় শাস্তি।’
(সুরা : আল ইমরান, আয়াত : ৭৭)
হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মিথ্যা সাক্ষ্য গুরুতর পাপের অন্তর্ভুক্ত, যা জাহান্নামে নিয়ে যায়।’
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৬৫৪)
জান্নাত থেকে বঞ্চিত হওয়া
মিথ্যা সাক্ষ্য ঈমানের পরিপন্থী। এমন অপরাধী ব্যক্তি জান্নাতের সুগন্ধ থেকে বঞ্চিত হতে পারে। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত যে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কসমের মাধ্যমে কোনো মুসলমানের হক বিনষ্ট করে তার জন্য আল্লাহ জাহান্নাম অবধারিত করে রেখেছেন এবং জান্নাত হারাম করে রেখেছেন। তখন জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসুল! অতি সামান্য বস্তু হলেও? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আরাকগাছের (বাবলাগাছের মতো এক ধরনের কাঁটাযুক্ত গাছের) ডাল হলেও এ শাস্তি দেওয়া হবে।’
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৩৭)
মিথ্যা সাক্ষ্য সৎকর্ম নষ্ট করে দেয়
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)
আল্লাহ আমাদের সত্যের পথে অটল রাখুন এবং মিথ্যার ভয়াবহতা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ