একদিন মুসা (আ.) বনি ইসরাঈলের হেদায়েতের জন্য ভাষণ দিচ্ছিলেন। হঠাৎ কেউ তাঁকে প্রশ্ন করল, পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা বড় আলেম কে? তিনি নবী হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই নিজের কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে বলেন, তোমার চেয়েও জ্ঞানী একজন ব্যক্তি আছেন।
মুসা (আ.)-এর মধ্যে তখন দেখা দিল অন্বেষী মনোভাব। তিনি আল্লাহর কাছে ওই ব্যক্তির সান্নিধ্যে গিয়ে ইলম অর্জনের আবেদন করেন। মহান আল্লাহ তাঁকে বলেন, থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে দুই নদীর সংযোগস্থলে যাও। এরপর যেখানে গিয়ে তা হারিয়ে ফেলবে সেখানেই তাকে পাবে...। (বুখারি, হাদিস : ১২২)
শিক্ষামূলক সফরের যাত্রা শুরু
মুসা (আ.) ইউশা ইবনে নুনকে সঙ্গে নিয়ে সফর শুরু করেন। গন্তব্য দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থল। সেখানেই আছেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা খিজির বা খাদির (আ.)। তাঁদের সঙ্গে খাদ্যের জন্য রাখা একটি মাছ চিহ্ন এঁকে তাঁর নির্ধারিত ঠিকানায় নিয়ে যায়।
বড় একটি মুজিজা প্রকাশিত হয়। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, যখন মুসা (আ.) তাঁর যুবক (সঙ্গী)-কে বলেন, দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে না পৌঁছা পর্যন্ত আমি আসব না অথবা আমি যুগ যুগ ধরে চলতে থাকব। অতঃপর যখন তাঁরা দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে পৌঁছালেন, তখন তাঁরা নিজেদের মাছের কথা ভুলে গেলেন। অতঃপর মাছটি সমুদ্রে সুড়ঙ্গ পথ সৃষ্টি করে নেমে গেল।
যখন তাঁরা সেই স্থানটি অতিক্রম করে গেলেন, মুসা (আ.) সঙ্গীকে বলেন, আমাদের নাশতা আন। আমরা এই সফরে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছি। সে বলল, আপনি কি লক্ষ করেছেন, আমরা যখন প্রস্তর খণ্ডে আশ্রয় নিয়েছিলাম, তখন আমি মাছের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। শয়তানই আমাকে এ কথা স্মরণ রাখতে ভুলিয়ে দিয়েছিল। মাছটি আশ্চর্যজনকভাবে সমুদ্রে নিজের পথ করে নিয়েছে। মুসা (আ.) বলেন, আমরা তো এই স্থানটিই খুঁজছিলাম।
অতঃপর তাঁরা নিজেদের চিহ্ন ধরে ফিরে চললেন। অতঃপর তাঁরা আমার বান্দাদের মধ্যে এমন একজনের সাক্ষাৎ পেলেন, যাঁকে আমি আমার পক্ষ থেকে রহমত দান করেছিলাম এবং আমার পক্ষ থেকে দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান। (সুরা কাহাফ, আয়াত : ৬০৬৫)
শিক্ষার জন্য সময় ও ধৈর্য
মুসা (আ.) খাদির (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কুশল বিনিময় করেন। এবং তাঁর কাছে ইলম শেখার আবেদন করেন। তিনি বলেন, কিছুতেই আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না। তখন মুসা (আ.) ধৈর্য ধারণের ওয়াদা করেন। অতঃপর তাঁরা একত্রে রওনা হন। কোরআনের ভাষ্য এমন : ‘অতঃপর তাঁরা চলতে লাগলেন। অবশেষে যখন তাঁরা নৌকায় আরোহণ করলেন, তখন তিনি তাতে ছিদ্র করে দিলেন।
মুসা (আ.) বলেন, আপনি কি এর আরোহীদের ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য এতে ছিদ্র করে দিলেন? নিশ্চয়ই আপনি একটি গুরুতর মন্দ কাজ করলেন। তিনি বললেন, আমি কি বলিনি যে আপনি আমার সঙ্গে কিছুতেই ধৈর্য ধরতে পারবেন না? মুসা (আ.) বলেন, আমাকে আমার ভুলের জন্য অপরাধী করবেন না এবং আমার কাজে আমার ওপর কঠোরতা আরোপ করবেন না। অতঃপর তাঁরা চলতে লাগলেন। অবশেষে যখন একটি বালকের সাক্ষাৎ পেলেন, তখন তিনি তাকে হত্যা করলেন।
মুসা (আ.) বললেন, আপনি কি একটি নিষ্পাপ জীবন শেষ করে দিলেন প্রাণের বিনিময় ছাড়াই? নিশ্চয়ই আপনি তো এক গুরুতর অন্যায় কাজ করলেন। তিনি বলেন, আমি কি বলিনি যে আপনি আমার সঙ্গে ধৈর্য ধরে থাকতে পারবেন না। মুসা (আ.) বলেন, এরপর যদি আমি আপনাকে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করি, তবে আপনি আমাকে সঙ্গে রাখবেন না। আপনি আমার পক্ষ থেকে অভিযোগ মুক্ত হয়ে গেছেন। অতঃপর তাঁরা চলতে লাগলেন, অবশেষে যখন একটি জনপদের অধিবাসীদের কাছে পৌঁছে তাদের কাছে খাবার চাইলেন, তখন তারা তাঁদের অতিথেয়তা করতে অস্বীকার করল।
অতঃপর তাঁরা সেখানে একটি পতনোন্মুখ প্রাচীর দেখতে পেলেন, সেটি তিনি সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। মুসা (আ.) বলেন, আপনি ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে এর পারিশ্রমিক আদায় করতে পারতেন। তিনি বললেন : এখানেই আমার ও আপনার মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হলো।
এখন যে বিষয়ে আপনি ধৈর্য ধরতে পারেননি তার তাৎপর্য বলে দিচ্ছি। (সুরা কাহাফ, আয়াত : ৭১-৭৮)
ওই ঘটনার বিবরণ দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মুসা (আ.) যদি আরো কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরতেন, তবে আরো কিছু জানা যেত। (বুখারি, হাদিস : ১২২)
বোঝা গেল শিক্ষার জন্য সময় ও ধৈর্য জরুরি।
তিন আপত্তির সঠিক জবাব
মুসা (আ.)-এর আপত্তির জবাবে খিজির (আ.) বলেন, নৌকাটি ছিল কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তির। তারা সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করত। আমি ইচ্ছা করলাম যে সেটিকে ত্রুটিযুক্ত করে দিই। তাদের অন্যদিকে ছিল এক বাদশাহ। সে বল প্রয়োগে প্রতিটি নৌকা ছিনিয়ে নিত। বালকটির ব্যাপার হলো, তার মা-বাবা ছিলেন ঈমানদার। আমি আশঙ্কা করলাম, সে অবাধ্যতা ও কুফর দ্বারা তাদের প্রভাবিত করবে। অতঃপর আমি ইচ্ছা করলাম, তাদের পালনকর্তা তাদের মহত্তর, তার চাইতে পবিত্রতায় ও ভালোবাসায় ঘনিষ্ঠতর একটি শ্রেষ্ঠ সন্তান দান করুক।
প্রাচীরের ব্যাপার- সেটি ছিল নগরের দুজন পিতৃহীন বালকের। এর নিচে ছিল তাদের গুপ্তধন এবং তাদের বাবা ছিলেন সৎ কর্মপরায়ণ। সুতরাং আপনার পালনকর্তা দায়বশত ইচ্ছা করলেন, তারা যৌবনে পদার্পণ করুক এবং নিজেদের গুপ্তধন উদ্ধার করুক।
আমি নিজ মতে এটা করিনি। আপনি যে বিষয়ে ধৈর্য ধারণ করতে অক্ষম হয়েছিলেন, এই হলো তার ব্যাখ্যা। (সুরা কাহাফ, আয়াত : ৭৯৮২)
ঐতিহাসিক সফরের সারাংশ
আল্লাহ তাআলার দুজন প্রিয় বান্দার এই ঐতিহাসিক ভ্রমণের সারাংশ হলো-
এক. আল্লাহর কাছে সুশাসক ও তার শাসন বড় পছন্দ। ন্যায়পরায়ণ শাসককে তিনি কিয়ামতের ময়দানে আরশের ছায়ার নিচে স্থান দিবেন। আর জালিম শাসকের পরিণতি হবে ভয়ংকর। জালিমের অত্যাচার থেকে তিনি মাঝি ও তার পরিবারের সদস্যদের বাঁচিয়েছেন নির্বাচিত দুজন ব্যক্তির মাধ্যমে।
দুই. যিনি গচ্ছিত দ্রব্য যথাযথ হেফাজতে রাখেন এবং তার মালিককে ফেরত দেন, তিনি প্রকৃত আমানতদার। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সততা ও আমানতদারিতা খুব প্রয়োজন। এ জন্য ইসলাম আমানতদারিতার প্রতি সমধিক গুরুত্বারোপ করেছে। সম্মানিত দুজন ব্যক্তির মাধ্যমে আমানতদার ব্যক্তির সম্পদ তার ওয়ারিশদের জন্য হেফাজতের সুব্যবস্থা করেছেন।
তিন. সন্তান আল্লাহর দেওয়া বড় নেয়ামত। সন্তানকে আদর্শবান হিসেবে গড়ে তোলা মা-বাবার নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। যথাযথ দায়িত্ব পালনেই সন্তান নেককার হিসেবে গড়ে ওঠে। সুসন্তান বাবা-মার গৌরব। দেশ ও জাতির প্রকৃত বন্ধু। ওই ঈমানদারকে কুসন্তানের বদৌলতে আল্লাহ তাকে সুসন্তান দান করেছিলেন। যাদের বংশবাতির মধ্যে অনেকেই নবী-রাসুল হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ