ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান সম্প্রসারণে সরকারের নেওয়া পরিকল্পনার বিরোধিতা করে ইসরায়েলজুড়ে বিক্ষোভ করেছেন হাজার হাজার মানুষ। গাজা নগরী দখলের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে দেশটির বিভিন্ন শহরের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন তারা। গতকাল বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত শুক্রবার ইসরায়েলের নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভা গাজা যুদ্ধ শেষ করার লক্ষ্যে পাঁচটি নীতির অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে গাজা উপত্যকার ‘নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার’ নীতিও রয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজা নগরী পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। স্থানীয় সময় শনিবার (৯ আগস্ট) অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন। তাদের মধ্যে গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হাতে জিম্মি ৫০ জনের পরিবারের সদস্যরাও রয়েছে। গাজায় এখনো অন্তত ২০ জিম্মি জীবিত আছেন বলে ধারণা করা হয়। গাজা নগরী দখলে ইসরায়েলি পরিকল্পনায় জিম্মিদের জীবনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া লোকজন জিম্মিদের দ্রুত মুক্তির ব্যবস্থা নিতে ইসরায়েলের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সামাজিক মাধ্যম এক্সে এক পোস্টে জিম্মিদের পরিবারের প্রতিনিধিত্বকারী একটি দল বলেছে, ‘গাজায় নতুন করে যুদ্ধের সম্প্রসারণ জিম্মি ও সৈন্যদের ঝুঁকিতে ফেলছে। ইসরায়েলের জনগণ তাদের ঝুঁকিতে ফেলতে রাজি নয়!’ জেরুজালেমে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এক ইসরায়েলি বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা যুদ্ধের অবসান চাই। কারণ আমাদের জিম্মিরা সেখানে মারা যাচ্ছেন। জিম্মিদের সবাইকে এখনই ঘরে ফেরানো দরকার।’ তিনি বলেন, ‘যা কিছু করা দরকার আমরা করব। যদি যুদ্ধ থামাতে হয়, তবে আমরা যুদ্ধ থামাব।’
এদিকে, গাজা দখল করা ইসরায়েলের উদ্দেশ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। গতকাল বিদেশি গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রেস ব্রিফিংয়ে একথা বলেন তিনি। নেতানিয়াহু বলেন, ‘গাজা দখল করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। সেখানে আমরা একটি বেসামরিক সরকার গঠন করতে চাই, যা হামাস ও ফিলিস্তিন অথরিটি সংশ্লিষ্ট নয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণ মানুষ নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য আমরা নিরাপদ করিডোর এবং ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র ঠিক করে দেব।’
ম্যাক্স ক্রেশ নামের ওই সৈনিক বলেন, তিনি গাজায় সংঘাতের শুরুতে একজন যুদ্ধরত সৈনিকের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু তারপর থেকে এই বাহিনীতে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তিনি। ম্যাক্স বলেন, ‘আমরা ৩৫০ জনের বেশি সৈনিক যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছি, এখন নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক যুদ্ধে সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছি। কারণ সরকারের পদক্ষেপ জিম্মিদের ঝুঁকিতে ফেলছে এবং গাজায় নিরপরাধ মানুষদের অনাহারে রাখছে।’
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস অব ইসরায়েল বলেছে, তেলআবিবে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সদরদপ্তরের কাছে জিম্মি ও সৈন্যদের পরিবার ইসরায়েলি সৈন্যদের যুদ্ধ বিস্তারের পরিকল্পনায় সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর আহ্বান জানিয়েছে। ইসরায়েলি গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এয়াল জামির প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, গাজা পুরোপুরি দখল করার পরিকল্পনা ‘একটি ফাঁদে পা’ দেওয়ার সমান। এতে জীবিত জিম্মিদের জীবনের ঝুঁকি বাড়বে।
দেশটিতে পরিচালিতে বিভিন্ন জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি ও যুদ্ধ শেষ করার জন্য হামাসের সঙ্গে চুক্তির পক্ষে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরায়েল গাজা উপত্যকা পুরোপুরি দখল করার পর ‘আরব বাহিনীর হাতে তুলে দেবে।’ শুক্রবার এক্সে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা গাজা দখল করতে যাচ্ছি না। আমরা গাজাকে হামাস থেকে মুক্ত করতে যাচ্ছি। এটি আমাদের জিম্মিদের মুক্তিতে সাহায্য করবে এবং গাজা যাতে ভবিষ্যতে ইসরায়েলের জন্য হুমকি না হয় সেটি নিশ্চিত করবে।’
ইসরায়েলের নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভার গাজা দখল পরিকল্পনায় পাঁচটি নীতি রয়েছে। এসব নীতি হলো, গাজায় হামাসকে নিরস্ত্র করা, সব জিম্মিকে ফিরিয়ে আনা, গাজা উপত্যকাকে সামরিক মুক্ত করা, নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ নেওয়া এবং হামাস কিংবা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ছাড়া অন্য একটি বিকল্প বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা।
চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘের শীর্ষ এক কর্মকর্তা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, গাজা নগরী পুরোপুরি দখল করা হলে তা ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক ও জিম্মিদের জন্য ‘বিপর্যয়কর পরিণতি’ ডেকে আনবে। গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলে প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনির বসবাস রয়েছে। যদিও যুদ্ধের আগে ওই অঞ্চলের সর্বাধিক জনবহুল শহর ছিল এটি।
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা ও আরও কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের গাজা দখলের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে। এই পরিকল্পনার বিরোধিতায় ইসরায়েলে সামরিক রপ্তানি বন্ধের হুমকি দিয়েছে জার্মানি। গতকাল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলের পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সূত্র: বিবিসি।