ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে, ২৪ জুন প্যারিসে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন ইরানের শেষ ‘শাহ’ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির ছেলে রেজা পাহলভি।
সংবাদ সম্মেলনে ধুসর স্যুট আর নীল টাই পরে, চুল পেছনে আঁচড়ে পরিপাটি করে রাখা ছিলেন ৬৪ বছর বয়সি নির্বাসিত ও স্বঘোষিত এ যুবরাজ। যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি আহ্বান জানান, দেশটি যেন তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আবার কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করে ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে (ইরান) ‘জীবনীশক্তি’ না দেয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হলে দেশটিতে শাহর রাজতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটে।
ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পথে দাবি করে রেজা পাহলভি বলেন, ‘এটাই আমাদের বার্লিন প্রাচীর ভাঙার মুহূর্ত।’ সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান এবং সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের পক্ষত্যাগ করতে বলেন। কিন্তু তাঁর এ ডাকে সাড়া দেননি ইরানিরা; বরং বিদেশি হামলার (ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের হামলা) মুখে ইরানের অনেকেই, এমনকি সরকারবিরোধীরাও জাতীয় পতাকার তলে ঐক্যবদ্ধ হন।
ফ্রান্সের প্যারিসে দেওয়া বক্তৃতায় যিনি নিজেকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির স্থলাভিষিক্ত হতে এবং দেশবাসীকে ‘শান্তি ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে’ নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়েছিলেন, তিনি (রেজা পাহলভি) সম্ভবত বাস্তবতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন।
ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে (ইরানের বর্তমান নেতৃত্বকে) উৎখাতের লড়াইয়ে নামতে রাজি ছিলেন পাহলভি। কিন্তু বেশির ভাগ ইরানিই তাতে সায় দেননি।
ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও ‘ ট্রেচারাস অ্যালায়েন্স : দ্য সিক্রেট ডিলিংস অব ইসরায়েল, ইরান অ্যান্ড দ্য ইউনাইটেড স্টেটস’ বইয়ের লেখক ত্রিতা পার্সি বলেন, ‘ইরানে ইসরায়েল ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে ৯৩৫-এর বেশি মানুষকে মেরে ফেলার ঘটনায় পাহলভি নিন্দা জানাননি। এতে আর কিছু না হলেও এক সময় যে সামান্য সমর্থন পাহলভি কুড়িয়েছিলেন, সেটুকুও তিনি নষ্ট করলেন।’
ত্রিতা আল-জাজিরাকে আরও বলেন, ‘ইসরায়েল যখন আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে বোমা ফেলে সাধারণ মানুষ হত্যা করছিল, তখন তিনি (পাহলভি) টিভিতে এসে তাদের (ইসরায়েলি) পক্ষ নিয়ে বক্তব্য দিলেন। এতে তিনি শাহ নামের ব্র্যান্ডটাই ধ্বংস করে ফেলেছেন।’
আল-জাজিরার পক্ষ থেকে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলেও পাহলভির দপ্তর কোনো সাড়া দেয়নি।
প্রজন্মভিত্তিক সমর্থন : রেজা পাহলভির প্রতি সমর্থনের পরিমাণ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, তা খুব বেশি নয়। তবু পাহলভির প্রতি যে অল্পস্বল্প সমর্থন আছে, তা মূলত ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বিরোধিতা ও পুরোনো রাজতন্ত্রের প্রতি নস্টালজিয়া (স্মৃতিকাতরতা) থেকেই এসেছে; বিশেষ করে প্রবাসী ইরানিদের মধ্যে এ সমর্থন চোখে পড়ে।
ব্রিটেনপ্রবাসী ব্রিটিশ-ইরানি তরুণী ইয়াসমিন (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমার পরিবারের অনেকে পাহলভিকে সমর্থন করেন। কারণ তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্রপূর্ব যুগের প্রতীক। তবে তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন যে স্পষ্ট, তা আমি মনে করি না।’ -আল-জাজিরা
ইয়াসমিনের খালা ইয়াসনা (৬৪) ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের কিছুদিন আগে পড়াশোনার জন্য যুক্তরাজ্যে চলে যান। তিনিও পাহলভিকে সমর্থন করেন সেই নস্টালজিয়ার কারণেই। তাঁর মতে, পাহলভি ইরানের ক্ষমতায় এলে পশ্চিমারা আর তাঁদের দেশকে ‘অচ্ছুত’ হিসেবে দেখবে না।
ইসরায়েল যখন আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে বোমা ফেলে সাধারণ মানুষ হত্যা করছিল, তখন তিনি টিভিতে এসে তাদের পক্ষ নিয়ে বক্তব্য দিলেন। এতে তিনি শাহ নামের ব্র্যান্ডটাই ধ্বংস করে ফেলেছেন।
ইয়াসনা বলেন, ‘তিনি (পাহলভি) আমার প্রজন্মের মানুষ। আমি (শাহর) রাজত্বের দিনগুলো স্পষ্ট মনে করতে পারি। তিনি আমেরিকা, ইউরোপ ও ইসরায়েলের খুব ঘনিষ্ঠ। আমাদের এমন কাউকে দরকার।’
বিশ্লেষকেরা আল-জাজিরাকে বলেন, ইরানে সরকারবিরোধী রাজনীতিকদের ওপর দমন-পীড়নের কারণে বিকল্প কোনো নেতার অভাবও পাহলভির প্রতি সমর্থনের একটি কারণ। তবে সেই সমর্থন অনেকাংশেই তাঁর দাদা রেজা খান ও বাবা মোহাম্মদ রেজা পাহলভির অতীতের ‘বিকৃত’ স্মৃতিভিত্তিক।
রেজা খান ধর্মীয় নেতাদের ক্ষমতা খর্ব করেন এবং নিজ বিরোধী ও সংখ্যালঘুদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে একটি জাতিগতভাবে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। মোহাম্মদ রেজার সময়ও এমন নিপীড়ন অব্যাহত ছিল।
ইতিহাসের ছায়া : পাহলভিরা দীর্ঘ ইতিহাসসমৃদ্ধ কোনো রাজবংশের উত্তরাধিকার ছিল না। রেজা খান ছিলেন একজন সেনা কর্মকর্তা। তিনি ১৯২০-এর দশকে ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৪১ সালে তাঁর জায়গায় আসেন মোহাম্মদ রেজা।
১৯৫১ সালের এপ্রিল মাসে ইরানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক ‘অ্যাংলো-পারস্য’ তেল কোম্পানির (বর্তমানে বিপি) মালিকানাধীন সম্পদ জাতীয়করণ করেন। এর জেরে ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সহায়তায় তাঁর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটে।
ইরানবিষয়ক ইতিহাসবিদ ও ‘স্টেট অব রেজিসট্যান্স : পলিটিকস, আইডেনটিটি অ্যান্ড কালচার ইন মডার্ন ইরান’ গ্রন্থের লেখক আসসাল রাদ বলেন, ‘ব্রিটিশরা মনে করত, ওটা তাদের তেল। তারা কোনোভাবেই অতীতের এই ঔপনিবেশিক আচরণের কথা স্বীকার করত না যে ওটা জোর করে নেওয়া হয়েছিল কিংবা ইরানের অধিকার ছিল ওটা ফেরত নেওয়ার।’
বিশ্লেষকেরা বলেন, ইরানে সরকারবিরোধী রাজনীতিকদের ওপর দমনপীড়নের কারণে বিকল্প কোনো নেতার অভাবও রেজা পাহলভির প্রতি সমর্থনের একটি কারণ। তবে সেই সমর্থন অনেকাংশেই তাঁর দাদা রেজা খান ও বাবা মোহাম্মদ রেজা পাহলভির অতীতের ‘বিকৃত’ স্মৃতিভিত্তিক।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের আগে শাহ ও মোসাদ্দেকের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছিল বলে উল্লেখ করেন ইতিহাসবিদ রাদ। মোসাদ্দেক প্রকাশ্যে শাহকে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে সমালোচনা করেন। শাহ সেনাবাহিনীর ওপর নিজের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে চাইলেও, মোসাদ্দেক জনসমর্থনের ভিত্তিতে ইরানকে একটি সাংবিধানিক গণতন্ত্রে রূপ দিতে চেয়েছিলেন।
মোসাদ্দেকের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের পর আবারও একনায়কতান্ত্রিকভাবে ২৬ বছর ধরে চলতে থাকে পাহলভি শাসন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ১৯৭৬ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শাহর ভয়ানক গোয়েন্দা সংস্থা (সাভাক) মিথ্যা সাক্ষ্য আদায় করতে বন্দিদের বৈদ্যুতিক তার দিয়ে পেটানো, ধর্ষণ, আঙুল ভেঙে দেওয়া, নখ তুলে ফেলাসহ নানাভাবে নির্যাতন চালাত।
‘শেষ পর্যন্ত, শাহর শাসন ছিল এক নিষ্ঠুর স্বৈরতন্ত্র, ছিল না গণতন্ত্র’, আল-জাজিরাকে বলেন ত্রিতা পার্সি।