ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ভলোদিমিরি জেলেনস্কি ও ইউরোপের নেতাদের সঙ্গে সোমবার দিনভর কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। রাশিয়ার যুদ্ধ থামানোর উপায় নিয়ে আলোচনা হয়েছে এই বৈঠকে। তবে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আলোচনার মূল বিষয় ছিল—ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি বা শান্তি চুক্তিতে রাজি হলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো তাকে কী ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে পারে।
গত ফেব্রুয়ারির বৈঠকে ট্রাম্পের সঙ্গে তিক্ত অভিজ্ঞতার পর এবার ভিন্ন কৌশল নিয়েছেন জেলেনস্কি। বৈঠক শুরু হওয়ার পর প্রথম কয়েক মিনিটেই অন্তত ছয়বার ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানান তিনি। পূর্ববর্তী বৈঠকে পর্যাপ্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করায় ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের তিরস্কার শুনতে হয়েছিল তাকে। এবার সামরিক পোশাকের পরিবর্তে গাঢ় রঙের স্যুট পরে আসেন জেলেনস্কি।
এতে ট্রাম্প মজা করে বলেন, ‘আজ বেশ সাজগোজ করে এসেছেন।’ এ ছাড়া জেলেনস্কি নিজের স্ত্রী ওলেনা জেলেনস্কার লেখা একটি চিঠি ট্রাম্পকে দেন, যা মেলানিয়া ট্রাম্পের কাছে পৌঁছে দিতে অনুরোধ করেন। হাস্যরস মিশিয়ে জেলেনস্কি বলেন, ‘এটা আপনার জন্য নয়, আপনার স্ত্রীর জন্য।’
গত শুক্রবার আলাস্কায় পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর সোমবার হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের জেলেনস্কির বৈঠকে সঙ্গে এসেছিলেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাখোঁ, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেৎস, ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাব ও নেটোর মহাসচিব মার্ক রুট।
এদিকে বৈঠকের মাঝপথেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ফোন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে জেলেনস্কি ও পুতিনের সরাসরি বৈঠকের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে আদৌ এমন বৈঠক হবে কি না, তা অনিশ্চিত। ক্রেমলিন জানিয়েছে, প্রায় ৪০ মিনিট ফোনে কথা বলেন ট্রাম্প ও পুতিন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রুথ সোশ্যালের পোস্টে দেওয়া এক পোস্টে ট্রাম্পও লিখেছেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি টেলিফোনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি পুতিনকে ফোন করে রুশ নেতা আর জেলেনস্কির মধ্যে বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া শুরু করেছেন।
ট্রাম্প আরো বলেছেন, এমন একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর তিনি এক ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে আয়োজন করবেন। পুতিন-জেলেনস্কির সঙ্গে এই বৈঠকে থাকবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টও। তবে, কোথায় বা কবে এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে সেটি নিয়ে নিশ্চিত করে বলেননি তিনি।
ইউরোপীয় নেতারা হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের সঙ্গে বসার আগে এমানুয়েল ম্যাখোঁ ও ট্রাম্পের কিছু কথোপকথন রেকর্ড করা হয়েছিল। তাতে শোনা যায়, ট্রাম্প ম্যাখোঁকে বলেন, ‘আমার মনে হয় তিনি (পুতিন) একটা চুক্তি করতে চায়। বিষয়টি যতই অদ্ভুত শোনায় না কেন সে আমার জন্য হলেও একটা চুক্তি করতে চায়। বুঝতে পারছেন?’
তবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ আগ্রাসনের পর চরম দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে এক টেবিলে আলোচনায় বসানো কতটা সহজ হবে সেটি এখনো অনিশ্চিত।
মাসের পর মাস ধরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। অনেকের মতে, তার এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য ছিল প্রমাণ করা যে রাশিয়া প্রকৃতপক্ষে শান্তি চায় না। কেননা, জেলেনস্কির বিশ্বাস—ক্রেমলিন কখনোই এ ধরনের বৈঠকে আগ্রহী নয়।
মস্কোও বারবার সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে, পুতিন–জেলেনস্কি বৈঠক তাদের পরিকল্পনায় নেই। তবে ক্রেমলিনের মুখপাত্র সম্প্রতি খানিকটা অস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘পুতিন–জেলেনস্কি বৈঠকে উচ্চপদস্থ প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।’
এই বৈঠকে ট্রাম্প স্পষ্ট করে জানান, শান্তিচুক্তির আগে যুদ্ধবিরতি অপরিহার্য নয়। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না যুদ্ধবিরতি কতটা জরুরি।’ ইউরোপীয় নেতারা এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেৎস ভাষায় বলেন, ‘আমি কল্পনাও করতে পারি না যে পরবর্তী বৈঠক যুদ্ধবিরতি ছাড়া হবে। আমাদের এ নিয়েই কাজ করতে হবে এবং রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়াতে হবে।’ অন্যদিকে, জেলেনস্কি এবার আগের মতো যুদ্ধবিরতির প্রসঙ্গ তোলেননি।
এদিকে ট্রাম্প জেলেনস্কিকে আশ্বাস দিয়েছেন, যুদ্ধ শেষ করার যেকোনো চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে পাশে থাকবে। তবে কী ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে, তা খোলাসা করেননি। তিনি সেনা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেননি, তবে সম্ভাবনাও নাকচ করেননি। ট্রাম্প বলেন, ‘ইউরোপের প্রতিরক্ষাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রও এতে যুক্ত থাকবে, আমরা তাদের ভালো সুরক্ষা দেব।’ এটিকে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিয়ে ট্রাম্পের সবচেয়ে স্পষ্ট অবস্থান হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তিনি আরো দাবি করেন, আলাস্কা বৈঠকে পুতিন শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে ইউক্রেনের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে সম্মত হয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে জেলেনস্কি জানান, নিরাপত্তা নিশ্চয়তার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে ৯০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রচুক্তি হবে। এর মধ্যে আধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও ক্ষেপণাস্ত্রবিরোধী প্রযুক্তির অস্ত্রও থাকবে, যা বর্তমানে ইউক্রেনের কাছে নেই।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের তৈরি ড্রোনও কিনবে, যা দেশীয় ড্রোন উৎপাদনে সহায়তা করবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিস্তারিত চুক্তি ১০ দিনের মধ্যেই তৈরি হতে পারে। বৈঠকে ইউরোপীয় নেতারাও ট্রাম্পের শান্তি প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন। তবে একইসঙ্গে ইউরোপীয় নেতারা জোর দিয়ে বলেন, রাশিয়ার ভবিষ্যৎ আগ্রাসনের হুমকি থেকে তারাও নিরাপদ নন।
সূত্র : বিবিসি।
বিডি-প্রতিদিন/শআ