নেপালে রক্তক্ষয়ী গণবিক্ষোভের পর স্থিতিশীলতা ফেরাতে ‘জেন জি’ তথা তরুণদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছে সেনাবাহিনী। বিক্ষোভের জেরে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর নেপালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ‘জেন জি’ বিক্ষোভকারীদের প্রথম পছন্দ দেশটির প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি।
বৃহস্পতিবার (১০ সেপ্টেম্বর) জেন জি’র একজন প্রতিনিধির বরাত দিয়ে কাঠমাণ্ডু থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানিয়েছে।
নেপালে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র রাজা রাম বাসনেট বৃহস্পতিবার রয়টার্সকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কে হচ্ছেন, তা নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা চলছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টাও চালানো হচ্ছে।
আর জেন–জি প্রতিনিধি ওজাশ্বি রাজ থাপা সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের প্রধান হিসেবে সুশীলা কার্কির নাম বিক্ষোভকারীদের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনীকে জানানো হয়েছে।
ওজাশ্বি রাজ থাপার ভাষ্যমতে, বিক্ষোভকারীরা চান নেপালের পার্লামেন্ট যেন ভেঙে দেওয়া হয়। তবে দেশের সংবিধান বাতিল করার পক্ষে নন তারা। আপাতত সংশোধনই যথেষ্ট বলে মনে করছেন।
আর বিক্ষোভকারীরা ক্ষমতায় থাকতে চান না বলে এএফপিকে জানিয়েছেন তাদের আরেক প্রতিনিধি সুদান গুরুং। তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারে কোনো অবস্থান চাই না। আমরা প্রকৃত সংস্কার চাই।’
বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মী রক্ষা বাম বলেন, ‘এই মুহূর্তে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সুশীলা কার্কির নাম উঠে আসছে। আমরা এখন প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপের অপেক্ষা করছি’।
রক্ষা বাম এএফপিকে জানান, আমরা সেনাপ্রধানের সঙ্গে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছি। আলোচনাটি ছিল কীভাবে আমরা দেশকে এগিয়ে নিতে পারি, দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে পারি— তা নিয়ে।
৭৩ বছর বয়সী নেপালের প্রথম নারী সুপ্রিম কোর্ট প্রধান বিচারপতি কার্কি এএফপিকে বলেন, সংসদ এখনও বহাল আছে। এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে বের করার জন্য বিশেষজ্ঞদের একত্রিত হওয়া দরকার।
জেন–জি ও সেনাবাহিনীর মধ্যে আলোচনার বিষয়ে জানাশোনা আছে এমন একজন রয়টার্সকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিতে সুশীলা রাজি আছেন। এখন তাকে নিয়োগের উপায় খোঁজা হচ্ছে।
নেপালের স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, সরকারপ্রধান হওয়ার প্রস্তাবে রাজি হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাওদেল ও সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন সুশীলা। এ বিষয়ে জানতে তার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল রয়টার্স। তবে সাড়া মেলেনি। সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করেননি তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান নিয়ে আলোচনার মধ্যে বৃহস্পতিবার একটি বিবৃতি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। তাতে তিনি বলেছেন, বর্তমানের কঠিন পরিস্থিতির সমাধান করতে সব ধরনের চেষ্টা করছেন তিনি। গণতন্ত্রের সুরক্ষার জন্য এবং শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকে এ চেষ্টা করা হচ্ছে। দ্রুতই সমস্যার সমাধান হবে—এ বিষয়ে সবাইকে আশ্বস্ত থাকতে বলেন প্রেসিডেন্ট।
নেপালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সুজিত কুমার ঝা। ৩৪ বছর বয়সী এই যুবক বলেন, ‘আমরা সুশীলাকে একজন সাহসী এবং নিজ সংকল্পে অটল মানুষ হিসেবে চিনি।’
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীদের সবাই সুশীলাকে সরকারপ্রধান হিসেবে সমর্থন করছেন না। তাই সর্বসম্মতভাবে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’
আলোচনায় আরও যারা:
নেপালের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে জেন–জিদের পছন্দ হিসেবে কুলমান গিসিংয়ের নামও শোনা যাচ্ছে। তিনি দেশটির বিদ্যুৎ বোর্ডের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। নেপালের বিদ্যুৎ–বিভ্রাট মোকাবিলা করে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি। সদ্য পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি তাঁকে বিদ্যুৎ বোর্ডের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন।
বৃহস্পতিবার এক বিবৃতি দিয়ে কুলমান গিসিংয়ের প্রতি সমর্থন জানান বিক্ষোভকারীদের একাংশ। বিবৃতিতে বলা হয়, সাংবিধানিকভাবে সুশীলা কারকি অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হতে পারেন না। কারণ, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের বিচারিক কাজের বাইরে অন্য কোনো দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়ে বিধিনিষেধ আছে। আর জেন–জি দের নেতা হওয়ার জন্য তিনি ‘অনেক বয়স্ক’।
এর আগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে কাঠমান্ডুর সাবেক ৩৫ বছর বয়সী বালেন্দ্র শাহর নাম শোনা যাচ্ছিল। একজন র্যাপার হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে তার। তবে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তিনি লিখেছেন, সুশীলা কার্কির প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।
বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনের মতো সেনারা রাজধানীর রাস্তায় টহল দিয়েছে। শহর শান্ত থাকলেও বিভিন্ন স্থানে একাধিক সেনা চৌকি বসানো হয়েছে। সোমবার কাঠমাণ্ডুতে সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধকরণ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। কিন্তু তা দ্রুত সারাদেশে ক্ষোভের বিস্ফোরণে রূপ নেয় এবং সরকারি ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসময় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রাণঘাতী দমন অভিযানে অন্তত ১৯ জন নিহত হয়।
নেপালের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, এদিন পর্যন্ত বিক্ষোভের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৪ জনে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি। এদিনও কাঠমান্ডুতে কারফিউ জারি ছিল। রাস্তায় ছিল সেনাসদস্যদের উপস্থিতি। বন্ধ ছিল স্কুল, কলেজ ও দোকানপাট। তবে জরুরি কিছু সেবা চালু করা হয়।
বিডি প্রতিদিন/নাজিম