যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা এবং প্রবল বর্ষণে শিশুদের একটি গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পে প্রাণঘাতী বিপর্যয় নেমে এসেছে। হঠাৎ বন্যায় ‘ক্যাম্প মিস্টিক’ নামে পরিচিত খ্রিস্টান শিশুদের শিবিরে নিহত হয়েছে অন্তত ২৭ জন, যাদের মধ্যে আট বছর বয়সী শিশুও রয়েছে।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত শুক্রবার রাতের আঁধারে ঘুমন্ত অবস্থায় বন্যার পানি কেবিন ভেদ করে ঢুকে পড়ে। একাধিক শিশুরা এবং কর্মী প্রাণ হারান, বহু মানুষ এখনও নিখোঁজ। টেক্সাসে সবমিলিয়ে মৃতের সংখ্যা ইতোমধ্যে ১০০ ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে শুধুমাত্র কার কাউন্টিতে প্রাণ হারিয়েছে ৮৪ জন।
এই বন্যাকে স্থানীয় কর্মকর্তারা বর্ণনা করেছেন, ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর দুর্যোগ হিসেবে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অঞ্চলের গড় জুলাই মাসের চারগুণ বৃষ্টিপাত ঘটে। কার কাউন্টির দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে ৫ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে মাত্র ৩ থেকে ৬ ঘণ্টায়। কোথাও কোথাও ২১ ইঞ্চি পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়।
কেন ঘটল এমন বিপর্যয়?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, একাধিক প্রাকৃতিক ও ভূ-আবহাওয়াগত কারণ এই দুর্যোগের জন্য দায়ী। মেক্সিকোতে সৃষ্ট একটি ট্রপিক্যাল স্টর্ম ধীরে ধীরে উত্তরে উঠে এসে বিপুল পরিমাণ আর্দ্রতা নিয়ে আসে। টেক্সাসের হিল কান্ট্রি অঞ্চলের উঁচু ভূমি সেই আর্দ্রতাকে আরও ওপরে ঠেলে দেয়, যার ফলে বড় বজ্রঝড় সৃষ্টি হয়।
এই ঝড়ের সমষ্টি এতটাই বড় হয়ে ওঠে যে নিজেরাই নিজেদের আবহাওয়াগত ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলে। ধীর গতির এই ঝড় থেকে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়, বিশেষ করে গুয়াডালুপ নদীর আশেপাশে। ফলে নদীটির তীর ভেঙে ভয়ংকর স্রোতে গ্রাস করে নেয় ক্যাম্প মিস্টিকসহ আশেপাশের অঞ্চলকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্ল্যাশ ফ্লাড অ্যালি নামে পরিচিত এই অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবেই হঠাৎ বন্যার জন্য পরিচিত। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে আসা পানি সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ে, ফলে পানি খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। শুক্রবার ভোররাতে এই পানির প্রবাহ এতটাই হঠাৎ এবং প্রচণ্ড ছিল যে মানুষ সেভাবে প্রস্তুতি নিতে পারেনি।
সতর্কতা যথেষ্ট ছিল না?
বৃহস্পতিবার বিকেলে বন্যা সতর্কতা জারি করা হলেও গভীর রাতে সেটি আপগ্রেড হয়ে ফ্ল্যাশ ফ্লাড সতর্কতায় পরিণত হয়। অনেকেই হয়তো ঘুমিয়ে ছিলেন, যার ফলে মুঠোফোনে আসা সতর্কবার্তা তারা পাননি কিংবা গুরুত্ব দেননি।
ক্যাম্প মিস্টিক ছিল নদীর মাত্র ৫০০ ফুট দূরত্বে, যেটি সবচেয়ে বেশি বর্ষণ এলাকায় অবস্থিত। এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সেখানে সবকিছু পানিতে ভেসে গিয়েছিল। কাঠের কেবিন ভেঙে গিয়েছে, কায়াক গাছের মাথায় আটকে আছে। ফলে কেবিনে থাকা মেয়েরা পানির স্রোতে ভেস যায়।
উদ্ধার ও ত্রাণ অভিযান
বেঁচে যাওয়া অনেককে উদ্ধার করে সামরিক ট্রাকে করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রোববার ঘটনাস্থলে পৌঁছানো বিবিসির একটি দল দেখে ক্যাম্পের প্রবেশপথ পুলিশের দ্বারা ঘেরা, এবং ধ্বংসস্তূপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন চরম আবহাওয়ার ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। উপসাগরীয় মেক্সিকোতে সাগরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকায় বায়ুমণ্ডলে বেশি আর্দ্রতা সৃষ্টি হয় যা বড় ঝড়ের ‘ইন্ধন’ হিসেবে কাজ করে।
ইউরোপীয় জলবায়ু পর্যবেক্ষক সংস্থা কোপারনিকাস জানায়, ২০২৪ সাল ছিল এই বিষয়ে রেকর্ড ব্রেকিং একটি বছর। তারা সতর্ক করছে, ভবিষ্যতে এমন চরম বৃষ্টিপাত এবং দুর্যোগ আরও ঘন ঘন এবং ভয়াবহ হবে যদি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন চলতে থাকে।
সূত্র: বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল