দেশের বাজারে বিদেশি মানহীন কসমেটিকস পণ্যের লাগামছাড়া দামে বিক্রি, শুল্ক ফাঁকি এবং আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণার অভিযোগে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট মহল। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলছে, এসব অনিয়মে যেমন সরকার প্রতিবছর শত শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি সাধারণ ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন। বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। অন্যদিকে দেশীয় শিল্প পড়েছে মারাত্মক বিপদে। সম্প্রতি এনবিআরের এক গোপন প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিদেশি একটি ব্র্যান্ডের আইলাইনার পণ্যের প্রকৃত আমদানি খরচ (শুল্ক ও পরিবহনসহ) মাত্র ৪ টাকা ৩১ পয়সা হলেও বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৯৪০ টাকা দামে। একইভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে মাত্র ৭৩ টাকায় আমদানিকৃত জনপ্রিয় ‘টি ট্রি ফেসওয়াশ’ (২০০ মি.লি.) দেশে বিক্রি হচ্ছে ৯৮০ টাকায়। এমন নজির শুধু একটি পণ্যের ক্ষেত্রে নয়। এক্সবিসি কোকোয়া বাটার ক্রিমের মতো আরও অনেক বিদেশি পণ্যে একই ধরনের আন্ডার ইনভয়েসিং ও অতিরিক্ত মূল্যহারে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। আসছে নতুন শুল্কনীতি, বাধা দিচ্ছে অসাধুরা। এনবিআর কসমেটিকস খাতে অনিয়ম ঠেকাতে নতুন শুল্কনীতি গ্রহণ করেছে, তবে অসাধু আমদানিকারকরা তা প্রতিরোধে মরিয়া। তারা আমদানিকৃত প্রসাধনী পণ্যকে ‘ফিনিশড গুডস’ দেখালেও শুল্ক পরিশোধ করছে কেবল মূল উপাদানের ওপর, যা আইনের পরিপন্থি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশীয় শিল্প হুমকির মুখে, কর্মসংস্থানে ঝুঁকি। অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অব বাংলাদেশের সভাপতি আশরাফুল আম্বিয়া বলেছেন, ‘সরকার এখনই ব্যবস্থা না নিলে দেশীয় শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। এতে লক্ষাধিক মানুষ বেকার হবে এবং দেশের শিল্পায়ন থমকে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একদিকে বিদেশি পণ্যে শুল্ক ফাঁকি, অন্যদিকে দেশীয় উৎপাদনের ওপর ভ্যাট ও শুল্ক এই দ্বৈত নীতির কারণে উদ্যোক্তারা এখন বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন।’
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দীন বলেন, ‘দেশীয় শিল্প বিকাশে কাঁচামালের ওপর শুল্ক হ্রাস ও সরাসরি প্রসাধনী আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধি জরুরি। দুদককে শুল্ক ফাঁকির বিষয়ে তদন্তে নামা উচিত।’
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম বাংলাদেশসহ (আইবিএফবি) সভাপতি এম এস সিদ্দিকী বলেন, কসমেটিকস পণ্য আমদানির আর কোনো প্রয়োজন নেই। দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা চাহিদা পূরণে যথেষ্ট।
ক্ষতির চিত্র ভয়াবহ এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী: ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সব আমদানিকারক মিলে প্রসাধনী খাতে সরকারকে রাজস্ব দিয়েছেন মাত্র ১৭ কোটি টাকা। অথচ দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানই রাজস্ব দিয়েছে ১০০ কোটি টাকার বেশি। শুধুমাত্র কালার কসমেটিকস খাতেই প্রকৃত আমদানি মূল্য ১৬০০ কোটি টাকা হওয়ার কথা থাকলেও আন্ডার ইনভয়েসের কারণে তা দেখানো হচ্ছে মাত্র ৫০০ কোটি টাকা। এতে শুল্ক ও ভ্যাট ফাঁকি হচ্ছে প্রায় ১১০০ কোটি টাকা।
অনেকেই মনে করছেন, বিদেশি পণ্যের প্রতি পক্ষপাত দেশীয় শিল্পের জন্য বিরূপ প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করেছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও এনবিআর-এর সাবেক উপদেষ্টা প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ বলেন, “বাংলাদেশে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার কসমেটিকস বাজার রয়েছে, যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১২.৫ শতাংশ। অথচ নীতিগত বৈষম্যের কারণে দেশীয় শিল্প এগোতে পারছে না।”
বাজারে নকল ও মানহীন বিদেশি প্রসাধনী পণ্যের ছড়াছড়ি থাকায় ভোক্তারা পড়ছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। এতে একদিকে যেমন ভোক্তা প্রতারিত হচ্ছেন, অন্যদিকে বিশ্বমানের দেশীয় পণ্যের বাজার হারাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দেশীয় কাঁচামালে শুল্ক হ্রাস, বিদেশি ফিনিশড কসমেটিকস আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধি, ভেজাল, চোরাই ও লাগেজ পার্টি পণ্য বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ, শুল্ক ফাঁকিবাজদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত ও স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য নীতি সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে ।এসব বাস্তবায়ন করা গেলে কসমেটিকস খাত বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাতে পরিণত হতে পারে।
শুল্ক ফাঁকি ও অতিমূল্য দাবিতে পরিচালিত বিদেশি প্রসাধনী পণ্যের বাজার দেশীয় শিল্পের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এখনই কঠোর নীতিগত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ না নিলে শুধু রাজস্বই নয়, হারাতে হবে সম্ভাবনাময় একটি শিল্পখাত এবং লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান।