যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার মেয়াদের প্রথম ১০০ দিনে নজিরবিহীন গতিতে নির্বাহী আদেশ জারি করে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হয়েছেন। লক্ষ্য ছিল সরকারি ব্যয় কমানো, প্রশাসনের কাঠামো সংকোচন করা ও আন্তর্জাতিক পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা পুনর্গঠন।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের জন্য এখন শুরু হচ্ছে আসল চ্যালেঞ্জ। নিজেকে ‘ডিলমেকার-ইন-চিফ’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া এই প্রেসিডেন্টকে এবার তার নীতিগুলো আইন আকারে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের মধ্যে দৃঢ় ঐক্য এবং কার্যকর সমন্বয়।
ফ্রাঙ্কলিন টেম্পলটন ইনস্টিটিউটের প্রধান বাজার বিশ্লেষক স্টিফেন ডোভার এক স্মারকে বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলেন, “ট্রাম্পের প্রথম ১০০ দিন গতি ও প্রভাবের দিক থেকে ছিল অত্যন্ত চমকপ্রদ। কিন্তু এখন শুরু হচ্ছে কঠিন ধাপ।”
তিনি বলেন, “পরবর্তী ১০০ দিনে আইন প্রণয়ন, বাজেট ঘাটতি মোকাবিলা এবং রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা হবে মূল চ্যালেঞ্জ। এর জন্য কংগ্রেসকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে এবং জোট গঠন করতে হবে।’
নির্বাহী ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা
ট্রাম্প প্রথম তিন মাসে অভিবাসন, সাংস্কৃতিক প্রশ্ন ও সরকারি ব্যয়ের বিষয়ে ১৪০টির বেশি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। তবে ওভাল অফিসের নির্বাহী ক্ষমতা একতরফা হলেও সীমাবদ্ধ; বিশেষ করে বাজেটসংশ্লিষ্ট বা দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কার্যকর করতে হলে কংগ্রেসে আইন পাস করাতে হয়।
সীমান্ত নিরাপত্তা, কর সংস্কার ও জ্বালানি উৎপাদনুসংক্রান্ত ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়নে এখন তাকে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস ও সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকানদের নিয়ে ঐক্য গড়তে হবে। কিন্তু অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অভিবাসননীতি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ে গণমত খারাপ হওয়ায় ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে, যা এই কাজে জটিলতা সৃষ্টি করছে।
একতরফা আদেশ টেকসই নয়
কংগ্রেসের বাইরে জারি করা নির্বাহী আদেশ যেকোনো ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট বাতিল করতে পারেন। এ ছাড়া এসব আদেশ বিভিন্ন আদালতে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, যা ট্রাম্পের পূর্ববর্তী মেয়াদে বহুবার দেখা গেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, টেকসই প্রভাব রাখতে হলে ট্রাম্পকে এখন রাজনৈতিক ঝুঁকি ও ঐকমত্যের রাজনীতি করতে হবে, যা এতদিন তার দরকার হয়নি।
‘দ্য আর্ট অব দ্য ডিল’ বইয়ের লেখক ট্রাম্প তার আগের (২০১৭-২০২১) মেয়াদে বিতর্কিত অনেক বিষয়ে আইন পাসে সফল হননি। যদিও সেই সময়ে ইসরায়েল ও আশপাশের কয়েকটি আরবদেশের মধ্যে শান্তিচুক্তি (আব্রাহাম অ্যাকর্ডস) ও কানাডার সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি করেছিলেন (যেটি পরে নিজের আরোপিত শুল্কে ক্ষতিগ্রস্ত হয়)।তবে ‘অবামাকেয়ার’ নামের স্বাস্থ্য বীমা আইন বাতিল করতে ব্যর্থ হন এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেও কোনো চুক্তিতে পৌঁছতে পারেননি।
রিপাবলিকান ভাঙনে জটিলতা
প্রথম ১০০ দিনে কংগ্রেস মাত্র পাঁচটি বিল আইনে পরিণত করতে পেরেছে—যা আধুনিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কম।
এখন রিপাবলিকানরা আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করেছে—যার মধ্যে ট্রাম্পের ২০১৭ সালের করছাড় আরো একবার কার্যকর করা এবং শ্রমিকদের বোনাস, অতিরিক্ত সময়ের আয় ও সামাজিক নিরাপত্তা কর বাতিলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে।
কিন্তু সমস্যা হলো—এই প্রস্তাবিত করছাড়ের সম্ভাব্য ব্যয় আগামী ১০ বছরে প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার বলে মনে করা হচ্ছে। কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অল্প থাকায় প্রায় নিখুঁত ঐক্য ছাড়া আইন পাস অসম্ভব।
সংরক্ষণশীলরা ব্যয় সংকোচ ছাড়া করছাড়ে রাজি নন, আর মধ্যপন্থীরা, যাদের সামনের বছরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে টিকে থাকতে কঠিন লড়াই করতে হবে—তারা নিম্নআয়ের মানুষের জন্য বরাদ্দ মেডিকেইড স্বাস্থ্যবীমা কমানোর বিরোধিতা করছেন।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা
অ্যান্ড্রু কনেস্কাস্কি, ২০১৭ সালের কর সংস্কার আলোচনার অন্যতম প্রধান রিপাবলিকান কৌশলবিদ, বলেন, পরবর্তী ১০০ দিন অনেক বেশি জটিল হবে।
তিনি আরো বলেন, ‘করনীতি নিয়ে আলোচনায় আসল বিষয় হলো গণিত। রাজনীতিবিদরা যতই তা চান না কেন অঙ্কের নিয়ম ভাঙা যায় না। সবাইকে খুশি করে এমন হিসাব মেলানো খুব কঠিন হবে।’
এদিকে সময়ও দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। ২০২৬ সালের কংগ্রেস নির্বাচনে কয়েকটি সুইং জেলা নির্ধারণ করে দেবে কে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে। ফলে ট্রাম্পের আইন পাস করানোর ক্ষমতা আগামী বছর আরো সংকুচিত হতে পারে।
তিনি বর্তমানে সিনেটের একটি বিশেষ পদ্ধতি ‘রিকনসিলিয়েশন’-এর ওপর নির্ভর করছেন, যার ফলে নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ হলে ডেমোক্র্যাটদের সহায়তা ছাড়াই আইন পাস সম্ভব।
এটি তার জন্য জরুরি, কারণ হাউসের ডেমোক্র্যাট নেতা হাকিম জেফরিজ ট্রাম্পের নীতিকে ‘অমানবিক’ ও ‘যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবোধবিরোধী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এই এজেন্ডা ‘মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হবে, যাতে তা আর কোনো দিন পুনরুজ্জীবিত না হয়।’
বিডি প্রতিদিন/নাজিম