জুলাই জাতীয় সনদে সব দলের স্বাক্ষর নিশ্চিত করতে মরিয়া জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রাষ্ট্র সংস্কার ইস্যুতে কমিশনের সঙ্গে যেসব দল বৈঠকে অংশ নিয়েছে তাদের স্বাক্ষরে উদ্বুদ্ধ করা হবে। এ নিয়ে নানা পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রথম পরিকল্পনা অনুযায়ী জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে বৈঠক করা হবে। এ প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে স্বাক্ষর না করা দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের চিন্তা করা হয়েছে। এতে বরফ না গললে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস হস্তক্ষেপ করবেন। এর অংশ হিসেবে তিনি দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন অথবা দলের শীর্ষ নেতাদের ফোন করে অনুরোধ জানাবেন। নির্বাচনের স্বার্থে একমত হওয়ার আহ্বান জানাবেন তিনি।
শুক্রবার জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূস, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করেন ঐতিহাসিক ‘জুলাই জাতীয় সনদ, ২০২৫’। সংলাপে থাকা ৩০টি দল ও জোটের মধ্যে বিএনপি, জামায়াতসহ ২৪টি রাজনৈতিক দলের নেতারা সনদে স্বাক্ষর করেন। মতভিন্নতার কারণে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্কসবাদী), গণফোরাম ও বাংলাদেশ জাসদ জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি।
কমিশন ও সরকারের অনুরোধে আজ দুপুরে সংসদ সচিবালয়ের এলডি হলে জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করবে গণফোরাম। গতকাল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। বাকি দলগুলোর সঙ্গেও শিগগিরই আলোচনা শুরু করবে বলে জানানো হয়েছে।
শুক্রবার জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দিলেও তাতে সই করেনি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন দল গণফোরাম। গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সংবিধানের ১৫০ এর ২ অনুচ্ছেদ তারা বলেছে বিলুপ্ত করা হবে এবং পঞ্চম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম তফসিলে রাখা হবে না। আমরা বলেছিলাম যে এটা যদি সংশোধন করে এবং প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্টস যদি এটা রাখে তাহলে আমরা স্বাক্ষর করব। আমাদের আশ্বস্ত করেছিল যে, এটা সংশোধন হবে। কিন্তু অনুষ্ঠানে গিয়ে চূড়ান্ত কপিটা আমরা পাইনি। শুধু স্বাক্ষরের কপিটা দেওয়া হয়েছিল। এজন্য আমরা স্বাক্ষর থেকে বিরত ছিলাম। কমিশন জানিয়েছে, আজ রবিবার দুপুরে গণফোরাম সনদে স্বাক্ষর করতে রাজি হয়েছে।
এদিকে সনদে স্বাক্ষর করাতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ রাখা হয়েছে। কমিশনও দলটির কয়েক নেতার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছে। নির্বাচন কমিশন থেকে দলীয় প্রতীক পাওয়ার পরই দলটি জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করবে বলে কমিশন সূত্র জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্বাক্ষরের বিষয়ে আমাদের সঙ্গে সরকার ও কমিশনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে। আমরা বলেছি সনদের আইনি ভিত্তি না দেওয়া হলে স্বাক্ষর করব না। সময়ই বলে দেবে এনসিপি সনদে স্বাক্ষর করবে কি না।
এদিকে কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার শেষ দিনে আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ায় সরকার। এখন এ সময়ের মধ্যে স্বাক্ষর না করা দলগুলোকে সনদে স্বাক্ষর করাতে চেষ্টা করবে সংশ্লিষ্টরা। কমিশন জানিয়েছে, যারা কমিশনের সংলাপে অংশ নিয়েছেন তারা সবাই এর স্টেকহোল্ডার। ধারাবাহিক বৈঠকে তারা মূল্যবান মতামত দিয়েছেন। দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সরকারের রাষ্ট্র সংস্কার ইস্যুতে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাই আমরা চাই সনদে তারা স্বাক্ষর করুক। যেসব মতভিন্নতা রয়েছে সেসব বিষয়ে উভয় পক্ষ ছাড় দেবে -এটাই প্রত্যাশা।
বিদ্যমান সংবিধানের চার মূলনীতিকে বাদ দেওয়া, অঙ্গীকারনামায় মৌলিক অধিকার পরিপন্থি ও স্বাধীনতার ঘোষণা বাদ দেওয়াসহ সাত কারণে সনদে স্বাক্ষর না করার কথা বলেছে বাম ধারার চার দল। দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিকে প্রকারান্তরে ‘অস্বীকার’ করা হচ্ছে এই সনদে। আদালতে প্রশ্ন করা যাবে না, এমন বিষয়ে অঙ্গীকার করে সনদে স্বাক্ষর করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানিয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দলগুলোকে রাজি করাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে।
আশা করি দলগুলো রাষ্ট্রীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে ও জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করবে।
নির্বাচন কমিশনে এখন নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৫২। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত আছে। কমিশন যে ৩০টি দলের সঙ্গে আলোচনা করে সনদ প্রস্তুত করেছে, তার মধ্যে নিবন্ধিত দলের পাশাপাশি অনিবন্ধিত কিছু দলও আছে।
অন্যদিকে নিবন্ধিত অনেক দল কমিশনের আলোচনায় ডাক পায়নি। মূলত ২০২৪ সালের গণ অভ্যুত্থানের ভূমিকা বিবেচনা করে দলগুলোকে বাছাই করেছিল ঐকমত্য কমিশন। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটে দলগুলো একমত হলেও গণভোটের ভিত্তি, দিন ও পদ্ধতি নিয়ে মতভিন্নতা আছে। এটি নিয়ে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ দেবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।