সিলেটের সাদাপাথরের মতো লুট হয়েছিল আরেক পর্যটন কেন্দ্র বিছনাকান্দির পাথর। রাতদিন উৎসব করে লুটে নেওয়া হয়েছিল পাথর। ‘লুট উৎসবের’ শেষ দিকে গত বছরের ৩ নভেম্বর টাস্কফোর্সের অভিযানে জব্দ করা হয় প্রায় ৩ কোটি টাকা মূল্যের ২ লাখ ৪৮ হাজার ৮০৯ ঘনফুট পাথর। জব্দকৃত পাথর দুই ইউপি সদস্যের জিম্মায় রেখে নিলামে বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করেছিল খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি)। কিন্তু জব্দকৃত পাথর জিম্মাদারের কাছ থেকে ফের লুট হয়ে যাওয়ায় আর নিলাম হয়নি। এ ঘটনায় অজ্ঞাতদের আসামি করে থানায় মামলা করেছিলেন জিম্মাদার এক ইউপি সদস্য। গত আট মাসে লুটপাটকারীদের শনাক্ত, গ্রেপ্তার কিংবা লুটকৃত পাথর উদ্ধার কোনোটিই করতে পারেনি পুলিশ। এমনকি ওই মামলার কথাই ভুলে গেছেন থানার ওসি। এক মামলা করেই হজম করে ফেলা হয়েছে ৩ কোটি টাকার পাথর।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের শেষের দিকে সিলেটের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র গোয়াইনঘাটের বিছানাকান্দিতে শুরু হয় পাথর লুট। বেপরোয়া পাথর লুটকারীরা পরিবেশ ধ্বংস করে অবৈধভাবে দিনরাত পাথর উত্তোলন করে বিভিন্ন এলাকার বাড়ির আঙিনা ও সড়কের পাশে মজুত করে রাখে। লুটের ফলে বিছানাকান্দি পর্যটন কেন্দ্র বিরানভূমিতে পরিণত হয়। লুটপাটের শেষ দিকে গত বছরের ৩ নভেম্বর টাস্কফোর্সের অভিযানে বিছনাকান্দি ও রুস্তুমপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় আড়াই লাখ ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়। জব্দকৃত পাথর রুস্তুমপুর ইউপি সদস্য জালাল উদ্দিন ও বিছনাকান্দি ইউপি সদস্য পাপলু মিয়ার জিম্মায় রাখা হয়। জব্দকৃত পাথর নিলামের জন্য গত বছরের ২০ ডিসেম্বর দরপত্র আহ্বান করে বিএমডি। গত ৮ জানুয়ারি শেষ দিনেও কেউ দরপত্র জমা দেয়নি। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, দুই ইউপি সদস্যের জিম্মায় থাকাবস্থায় জব্দকৃত পাথর প্রকাশ্যে লুট হয়ে যায়। ওপরে বালুর আস্তরণ দিয়ে পাথর ভর্তি ট্রাক নিয়ে যাওয়া হয়। সেই সময় বিষয়টি ইউএনও, এসিল্যান্ড, ওসি ও বিট পুলিশ কর্মকর্তাকে অবগত করা হলেও তারা কেউই চুরি ঠেকাতে কোনো উদ্যোগ নেননি। অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনের যোগসাজশেই লুটের পাথর ফের লুট করা হয়। পাথর লুট শেষ হওয়ার পর জিম্মাদার দুই ইউপি সদস্যকে দিয়ে মামলা করানোর উদ্যোগ নেয় উপজেলা প্রশাসন। অজ্ঞাতদের আসামি করে থানায় মামলা করেন রুস্তুমপুর ইউপি সদস্য জালাল উদ্দিন। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পান বিছনাকান্দি বিট পুলিশিং কর্মকর্তা এসআই রাকিব হোসেন। কিন্তু গত আট মাসেও তিনি মামলার তদন্তের কোনো অগ্রগতি করতে পারেননি। এমনকি পাথর উদ্ধার কিংবা কোনো আসামি গ্রেপ্তার করতে পারেননি তিনি।
এসআই রাকিব হোসেন জানান, আট মাস ধরে মামলাটি তদন্ত করলেও এখনো লুটের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তাই কাউকে গ্রেপ্তার কিংবা মামলার চার্জশিট দেওয়া যায়নি। মামলার বাদী রুস্তুমপুর ইউপি সদস্য জালাল উদ্দিন জানান, নিরাপত্তাকর্মী দিয়েও তিনি পাথর রক্ষা করতে পারেননি। লুটের বিষয়টি তিনি তৎকালীন ইউএনও, এসিল্যান্ড, ওসি ও তদন্ত কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন। উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসন লুট বন্ধে ন্যূনতম কোনো উদ্যোগই নেননি। তাদের নীরবতা ও গাফিলতির কারণে লুট ঠেকানো যায়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি লুটের ঘটনায় থানায় মামলা করেন।
জব্দকৃত পাথর লুটের সঙ্গে কারা জড়িত ছিল- এমন প্রশ্নে জালাল উদ্দিন বলেন, যাদের কাছ থেকে পাথর জব্দ করা হয়েছিল, পরবর্তীতে তারাই এ পাথর লুটে নিয়েছিল। গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রতন কুমার অধিকারী জানান, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে এ ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হলেও পরবর্তীতে পুলিশ কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা তাঁর জানা নেই। লুটের পাথর উদ্ধার ও মামলার তদন্তের অগ্রগতি প্রসঙ্গে গোয়াইনঘাট থানার ওসি সরকার তোফায়েল আহমদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মামলাটির তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা তার মনে পড়ছে না। খোঁজ নিয়ে তিনি পরে জানানোর কথা বললেও আর জানাননি।
প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিটি : সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর লুটের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। গতকাল এ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এ ছাড়া, লুটের সঙ্গে জড়িতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের আশ্বাস দিয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার। দুপুরে কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ যান সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী। উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি। পরে তিনি মুখোমুখি হন গণমাধ্যমের। এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, সাদাপাথর লুটপাটকারীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি হচ্ছে। গোয়েন্দাসহ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে খুবই সতর্কতার সঙ্গে কাজ চলছে। যাতে প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করা যায় এবং নিরপরাধ কেউ হয়রানির শিকার না হয়। পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির পর তা প্রকাশ করা হবে।