আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের মোট কাজের প্রায় ৯০ ভাগই নিয়ে গেছে ১৫টি প্রতিষ্ঠান। এর অন্যতম তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। মজার ব্যাপার হলো, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে তমা কনস্ট্রাকশনের সড়ক ও জনপথের কাজের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। কিন্তু অভিজ্ঞতা না থাকলে কী হবে, তারা একের পর এক টেন্ডার পায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ)। ১ হাজার ১১০টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও মাত্র ১৫টি ৯০ শতাংশ কাজ করেছে। এ ১৫ প্রতিষ্ঠানের সবই ছিল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যদের আশীর্বাদপুষ্ট। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকটিরই কাজের অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু একেবারে অভিজ্ঞতাহীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড।
সওজের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়া ঠিকাদারের মধ্যে তমা কনস্ট্রাকশনের অবস্থান ১৩তম। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রেল, স্থানীয় সরকার, গণপূর্ত, নৌসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের বিপুল পরিমাণ কাজ পেয়ে আলোচনায় উঠে আসে এ প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির মালিক আতাউর রহমান ভূঁইয়া নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। তিনি বিগত ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম তমা কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যদিও তিনি এটি অস্বীকার করতেন। কিন্তু বাস্তবে এসব কাজে আজমের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। আওয়ামী লীগের শাসনামলে তমা কনস্ট্রাকশন প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার কাজ করে সড়ক ও জনপথ বিভাগে। যদিও এ কাজে তাদের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। ২০০০ সালে ঢাকার মিরপুর রোডের সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে নির্মাণাধীন পদচারী সেতুর (ফুটওভার ব্রিজ) গার্ডার পড়ে মারা যান মাগুরা টেক্সটাইলসের একজন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন। সেই ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের কাজ করছিল তমা কনস্ট্রাকশন! কিন্তু এ ঘটনার বিচার দূরের কথা, তদন্তও হয়নি। এ ধরনের ঘটনার পর তমা কনস্ট্রাকশনের সওজে কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা; কিন্তু বাস্তবে হয় উল্টো। তারা একের পর এক কাজ পেতে থাকে। কারণ মির্জা আজম। তমা সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভারের সাবকন্ট্রাক্টের নির্মাণকাজ করতে গিয়ে। নির্মাণশ্রমিকদের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত না করেই তমা কনস্ট্রাকশন এখানে চার-পাঁচ বছর কাজ করে গেছে, যাতে ৯ জন মানুষ নিহত হয়েছে। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও নেওয়া হয়নি পথচারী কিংবা কর্মীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা। এভাবেই মির্জা আজমের আশীর্বাদে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছে তমা। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় খুব বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে সুকৌশলে পছন্দের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশনকে কাজ পাইয়ে দেওয়া হয়। যদিও তাদের আবেদনের যোগ্যতা নিয়ে তখনই প্রশ্ন ছিল। কারণ তমার ইতঃপূর্বে এ ধরনের বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা ছিল না। ফ্লাইওভার প্রকল্পটি অনুমোদন থেকে শুরু করে বাস্তবায়নের ধাপে ধাপে অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে তমা কনস্ট্রাকশন। প্রতিষ্ঠানটি ইচ্ছা করেই নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করেনি। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সময় বাড়ানোর সঙ্গে তিন দফায় বাড়ানো হয়েছে নির্মাণ ব্যয়ও। মগবাজার ফ্লাইওভার প্রকল্পের বাজেট ছিল ৩৩৪ কোটি টাকা, যা শেষমেশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২২৯ কোটি। অতিরিক্ত খরচ ৮৯৫ কোটি টাকা, যা পুরোটাই লুটপাট। ৪০ কোটি টাকার ঢাবির হল ‘বিজয় একাত্তর’ ৫৯ কোটিতে নির্মাণ করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের প্রায় ৪ বিঘা জমি দীর্ঘ ছয় বছর দখলে রেখে ব্যবসা করেছে তমা কনস্ট্রাকশন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীরা একাধিকবার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আদালত থেকেও মাঠটি দখলমুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু কোনো কিছুই কাজে আসেনি ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের কাছে। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায় প্রায় ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘খুলনা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীনে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় তমা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড। অনুসন্ধানে দেখা যায়, এ কাজ পাওয়ার প্রাকযোগ্যতাই ছিল না তমার। তমাকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্যই টেন্ডার স্পেসিফিকেশন পরিবর্তন করা হয়। তমাকে কাজ পাইয়ে দিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পর্যন্ত গিয়েছিলেন মির্জা আজম। জোর করে প্রভাব খাটিয়ে ৩৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীর উত্তরায় ফ্ল্যাট নির্মাণের দায়িত্ব পায় তমা কনস্ট্রাকশন। ৬৭২টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজেও সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে। নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কাজ করার অভিযোগ ওঠে তমার বিরুদ্ধে। রাজউক তিন দফা চিঠি দিয়ে এসব নিম্নমানের কাজ নিয়ে অভিযোগ করে। একবার রাজউক কাজও বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু এসব কাজে সব ‘মুশকিলের আসান’ ছিলেন মির্জা আজম। মজার ব্যাপার হলো, এসব ফ্ল্যাট এতই নিম্নমানের যে এখানে কেউ থাকে না। যাঁরা নিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই আবার রাজউকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য আটটি কোম্পানির সঙ্গে সরকার চুক্তি করে। রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে গোল্ডেনবার্গের সহযোগী কোম্পানিগুলোর অন্যতম তমা কনস্ট্র্রাকশন। অথচ এ ধরনের কাজে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা তাদের নেই। গোল্ডেনবার্গ তমাকে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। কিন্তু মির্জা আজমের হস্তক্ষেপে তমা এ প্রকল্পে যুক্ত হয়। ২৬৬ কোটি টাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেন প্রকল্পে রায়মণি থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ২৭ দশমিক ৩৩ কিলোমিটারের কাজ করে তমা কনস্ট্রাকশন। এসব কাজেও হয় টেন্ডার জালিয়াতি। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এ কাজ হাতিয়ে নেয় তমা। যেখানেই দুর্নীতি সেখানেই তমা-মির্জা আজম। রেল এবং সড়কের কাজই নয়, তমা ট্যাক্সিক্যাবের ব্যবসাও শুরু করে। এ কাজে তমা হাতিয়ে নেয় হাজার কোটি টাকা। শুল্কমুক্ত কোটায় ক্যাব এনে তা গাড়ি হিসেবে বিক্রি করেছে তমা। এ অভিযোগের তদন্ত হলেও প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। ২ লাখ ১ হাজার টন চাল-গম রাখতে স্টিলের গুদাম নির্মাণে ৫১৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা লাগার কথা। আর এভাবেই অনুমোদন হওয়া সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবের প্রকিউরমেন্ট প্ল্যানে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্যাকেজ-৩-এ উল্লেখ করা আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও মধুপুরের তিনটি সাইলো নির্মাণে লাগছে ৯৬০ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন সাইলো নির্মাণের এ কাজটি পায় তমা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড। তমা যেখানেই কাজ পেয়েছে, সেখানেই ব্যয় বৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছে। ব্যয় বৃদ্ধির টাকা মূলত লুট হয়েছে; যার মোটা অঙ্ক পেয়েছেন মির্জা আজম। শত শত সরকারি নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত তমা গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিককে সামনে রাখা হলেও বিনা বিনিয়োগে এর মূল মালিক জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমানের আদরের শ্যালক মির্জা আজম, যিনি শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী। রেলওয়ে ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অনেক বড় ঠিকাদারি কাজ পেয়ে থাকে তমা কনস্ট্রাকশন। তমা নানান অপকর্ম, সময়মতো কাজ না করে ৩-৪ গুণ খরচ বাড়ানো, নিম্নমানের কাজ করে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন করা, অনিরাপদ কর্মপরিবেশে বহু মানুষ হত্যাকারী ঠিকাদার হয়েও হাজার হাজার কোটি টাকার সরকারি কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে। কারণ তাদের লাঠিয়াল ছিলেন মির্জা আজম।