ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের দিন স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকবে। গণনার সময় ভোট কেন্দ্রে থাকবেন সেনাসদস্যরা। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এদিকে নবাব নওয়াব আলী সিনেট ভবনে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ের সামনে সংবাদ সম্মেলনে গতকাল চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মো. জসীম উদ্দিন জানান, ডাকসু নির্বাচনে ২৮টি পদে লড়বেন ৪৭১ প্রার্থী। নারী প্রার্থী ৬২ ও পুরুষ প্রার্থী ৪০৯ জন। ভিপি পদে ৪৫, জিএস পদে ১৯ এবং এজিএস পদে লড়বেন ২৫ প্রার্থী। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে প্রচারণা। আভাস পাওয়া যাচ্ছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের।
কমিশনের তথ্যমতে, শীর্ষ তিন পদ ছাড়া সম্পাদকীয় পদগুলোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে ১৭, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে ১২, কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ১১, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক পদে ১৫, ক্যারিয়ার সম্পাদক পদে ১৫, সমাজসেবা সম্পাদক পদে ১৭, ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদে ১২, ক্রীড়া সম্পাদক পদে ১৩, গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে ৯, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ১৯, আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে ১৪, মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক পদে ১১ এবং কার্যনির্বাহী সদস্য পদে ২১৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
নারী প্রার্থী ৬২ জনের মধ্যে ভিপি পদে ৫, জিএস পদে ১, এজিএস পদে ৪, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন পদে ২, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে ১, কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ৯, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক পদে ৩, ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক পদে ২, সমাজসেবা সম্পাদক পদে ১, ক্রীড়া সম্পাদক পদে ১, গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে ৩, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ২, মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক পদে ৩ এবং সদস্যপদে ২৫ জন নারী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। রিটার্নিং অফিসার গোলাম রাব্বানী বলেন, ভোট কেন্দ্রের ভিতরে নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজনে সেনাবাহিনী থাকবে।
ব্যালট নম্বর : আলোচনায় শীর্ষে থাকা ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খানের ব্যালট নম্বর ২১, শিবির সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েমের ব্যালট নম্বর ২২, জিএস পদপ্রার্থী এস এম ফরহাদের ৪, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য থেকে ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমার ৬, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেল থেকে ভিপি প্রার্থী আবদুল কাদেরের ২, জিএস পদপ্রার্থী আবু বাকের মজুমদারের ১১, ছাত্র অধিকার পরিষদ সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী বিন ইয়ামীন মোল্লার ১৯, বামজোট সমর্থিত প্যানেল থেকে ভিপি প্রার্থী শেখ তাসনিম আফরোজ ইমির ৪৪, জিএস পদ প্রার্থী মেঘমল্লার বসুর ব্যালট নম্বর ৬।
গতকাল বিকালে ভিসি চত্বরে স্মৃতি চিরন্তনে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল মনোনীত প্যানেলের প্রার্থীরা। ‘প্রতিশ্রুতি নয় পরিবর্তনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ স্লোগান সামনে রেখে ছাত্রদল মনোনীত প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) আবিদুল ইসলাম খান আনুষ্ঠানিক প্রচারণার ঘোষণা দেন। এদিন দুপুর ২টায় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করে শিবির সমর্থিত প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’। নির্বাচনের ইশতেহার তুলে ধরে ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম বলেন, আমরা শিক্ষার মান বাড়াতে টিচার্স ইভাল্যুয়েশন (শিক্ষক মূল্যায়ন) সিস্টেম চালু করব। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, সায়েন্স লাইব্রেরি, ই-লাইব্রেরিসহ সব লাইব্রেরিকে আধুনিকায়ন করব। বিশ্ববিদ্যালয়কে সায়েন্স ও টেকনোলজিতে এগিয়ে নিতে বিশ্ববিদ্যালয়কে বাধ্য করব। রপ্তানির অন্যতম খাত লেদার ইনস্টিটিউটকে আধুনিকায়ন করে ঢেলে সাজাব। ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট তাদের সততা, দক্ষতা কাজে লাগিয়ে জুলাইয়ের চেতনা ধারণ করে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করে যাবে।
এদিন দুপুর পৌনে ১২টার দিকে উমামা ফাতেমার নেতৃত্বে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য জগন্নাথ হলের বধ্যভূমিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করে। এ ছাড়া ইসলামী ছাত্র আন্দোলন সমর্থিত প্যানেল সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে কাজী নজরুল ইসলামের কবর জিয়ারতের মাধ্যমে, বামপন্থিদের প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেল ফুলবাড়ী অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে শহীদদের প্রতি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে প্রচারণার অনুষ্ঠানিকতা শুরু করে।
এ ছাড়া অন্যান্য প্যানেল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট থেকে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণা শুরু করেন। ফুল ও লিফলেট বিলির মাধ্যমে অনেক প্রার্থীকে প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা যায়।
প্রচারণার প্রথম দিনেই উত্তাপ : প্রচারণার প্রথম দিনেই ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের নেতাদের ছবিসংবলিত ফেস্টুন ফেলে দেওয়া ও ছবিতে কালি দিয়ে বিকৃতির ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় গতকাল দুপুর ২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী এস এম ফরহাদ বলেন, আজকে প্রচারণার প্রথম দিনে ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের ফেস্টুন ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এটা খুবই দুঃখজনক। নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই এটা খুঁজে বের করে অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
নির্বাচন কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. জসিম উদ্দিন বলেন, আমরা এ ব্যাপারে এখনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ : বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের এজিএস প্রার্থী আশিকুল হক রিফাতের বিরুদ্ধে হলে ছাত্রদলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বাধা দেওয়া এবং ব্লাকমেলের অভিযোগ করেছেন ছাত্রদল মনোনীত ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান। সোমবার বিকালে মধুর ক্যান্টিনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে এমন অভিযোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, আমরা তথ্য পেয়েছি স্যার এ এফ রহমান হলে এক সাংবাদিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। যেসব শিক্ষার্থী ছাত্রদলের প্যানেলের পক্ষে কাজ করছে তাদের সে বাধাগ্রস্ত করছে।
অভিযুক্ত রিফাত সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী এবং আমাদের সময় পত্রিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি। তিনি অভিযোগের বিষয়টি ভিত্তিহীন বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ছাত্রদলের সংবাদ সম্মেলনে সহসভাপতি (ভিপি) পদপ্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান আমার বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অপপ্রচার চালিয়েছেন। আমার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় শঙ্কিত হয়েই তারা এ ধরনের অসত্য প্রচারণা চালাচ্ছেন। আবিদুল ইসলাম খানকে উত্থাপিত অভিযোগের যথাযথ প্রমাণ উপস্থাপন করতে আহ্বান জানান তিনি। তার দাবি, অভিযোগের ব্যাপারে প্রমাণ উপস্থাপন করতে আহ্বান করার ২৪ ঘণ্টা পরও ছাত্রদলের ভিপি ক্যান্ডিডেট আবিদ এখনো কোনো ক্ল্যারিফিকেশন দেননি। ফোনও রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে আবিদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার সংক্রান্ত অভিযোগ দেন আশিকুল ইসলাম।
এদিকে উমামা ফাতেমা এবং তার প্যানেল স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য টিএসসিতে ব্যানার টানানোয় নির্বাচন কমিশনের কাছে নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙের লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন স্বতন্ত্র এজিএস প্রার্থী আশিকুর রহমান জীম। অভিযোগপত্রে জিম বলেন, নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত আচরণবিধি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন টাঙানো নিষিদ্ধ। অথচ উল্লিখিত প্যানেল এ নিয়ম অমান্য করে টিএসসিতে ব্যানার স্থাপন করেছে, যা সুস্পষ্টভাবে আচরণবিধির পরিপন্থি।
নির্বাচন কমিশন বিশেষ গ্রুপকে আলাদা সুবিধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন শিবির সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন আমাদের বলছে প্রচারণা নিষেধ কিন্তু অন্যরা যখন প্রচারণা করছে তখন তারা জানাচ্ছে- তোমরাও এভাবে প্রচারণা করতে পার। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যাবে।