কাশ্মীরে সাম্প্রতিক হামলার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ভারত। এরই অংশ হিসেবে নয়াদিল্লি সিন্ধু পানি চুক্তি (আইডব্লিউটি) থেকে নিজেদের অংশগ্রহণ ‘স্থগিত’ করার ঘোষণা দিয়েছে। ভারতের এমন পদক্ষেপে চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং পাকিস্তানে দেখা দিয়েছে গভীর উদ্বেগ।
গত মাসে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এক হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। ভারত এই হামলার জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করলেও ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করেছে। হামলার জেরে দুই দেশের মধ্যে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়, যা পরবর্তীতে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে থেমে যায়।
ঐতিহাসিক চুক্তি বড় ধাক্কায়
সিন্ধু পানি চুক্তিটি ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির আওতায়, পূর্বাঞ্চলের তিনটি নদী— সতলজ, বিয়াস ও রাভি— ভারতের ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত হয়, আর পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি নদী—সিন্ধু, জেলাম ও চেনাব—প্রধানত পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ থাকে।
চুক্তিতে একতরফাভাবে তা বাতিল বা স্থগিত করার সুযোগ নেই এবং বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক সালিশি ব্যবস্থার কথাও উল্লেখ রয়েছে। তবুও ভারতের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে চুক্তিটি কার্যত বড় ধাক্কা খেয়েছে।
ভারতের কৌশল ও পরিকল্পনা
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নয়াদিল্লি এখন এমন প্রকল্প হাতে নেওয়ার কথা ভাবছে, যেগুলোর মাধ্যমে পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত নদীগুলোর পানিপ্রবাহ কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে। ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যদি পাকিস্তান ‘সন্ত্রাসবাদে সমর্থন’ বিশ্বাসযোগ্যভাবে ত্যাগ না করে, তবে চুক্তির কার্যকারিতা পুনরায় বিবেচনা করা হবে না।
পাকিস্তানের সতর্কবার্তা
পাকিস্তান স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, তাদের বরাদ্দ পানির প্রবাহ বন্ধ বা সরিয়ে দেওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টা ‘যুদ্ধ ঘোষণার’ শামিল হবে। ইসলামাবাদ বলছে, সিন্ধু পানি চুক্তি একটি আন্তর্জাতিক বাধ্যতামূলক চুক্তি, যা কোনো পক্ষ একতরফাভাবে স্থগিত করতে পারে না।
পানি নিয়ে চলমান উদ্বেগ
দুই দেশের মধ্যে সিন্ধু নদীর পানি ব্যবহারে দীর্ঘদিন ধরেই নানা বিরোধ রয়েছে। পাকিস্তানের অভিযোগ, ভারত উজানে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণ করে অন্যায্যভাবে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। পাকিস্তানের কৃষিজমির প্রায় ৮০ শতাংশই এই নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল।
সম্প্রতি পাকিস্তান কিশানগঙ্গা ও রাতলে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত ও নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের হস্তক্ষেপ চেয়েছে। তবে ভারত দাবি করছে, এসব প্রকল্প চুক্তির আওতায় বৈধ। নয়াদিল্লির অভিযোগ, পাকিস্তান ইচ্ছাকৃতভাবে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করছে।
স্থগিত সিদ্ধান্তের তাৎক্ষণিক প্রভাব
চুক্তি স্থগিত হলেও তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানে পানিপ্রবাহে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে না বলে মনে করা হচ্ছে, কারণ ভারতের পানিসংরক্ষণ সক্ষমতা সীমিত। তবে চলতি বছরের মে মাসে ভারতের কিছু প্রকল্পে রক্ষণাবেক্ষণ কাজ চলাকালে পাকিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রহণস্থলে পানিপ্রবাহ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।
চুক্তি স্থগিত থাকলে ভারত আর পাকিস্তানকে বন্যা পূর্বাভাস, পানিপ্রবাহ তথ্য বা মৌসুমি পানি ছাড়া সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করবে না। এমনকি শুষ্ক মৌসুমে ন্যূনতম পানি ছাড়ার বাধ্যবাধকতাও ভারতের আর থাকছে না।
কৃষিতে চরম প্রভাব
পাকিস্তানের কৃষি খাতে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। পাকিস্তান এগ্রিকালচার রিসার্চ-এর প্রধান গাশারিব শওকত বলেন, এই চুক্তিই আমাদের কৃষির মেরুদণ্ড। পানি প্রবাহ অনিয়মিত হলে সেচনির্ভর ফসল যেমন গম, ধান ও আখ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলন কমবে, খরচ বাড়বে, খাদ্যের দাম বেড়ে যাবে। ক্ষুদ্র কৃষকরা সবচেয়ে বেশি চাপে পড়বে।
পাকিস্তানের জাতীয় কৃষক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খালিদ হোসেন বাথ ভারতের পদক্ষেপকে ‘প্রকৃত যুদ্ধ ঘোষণা’ বলে উল্লেখ করে বলেন, আমরা ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানি সংকটে আছি। এ বছর বৃষ্টিপাত ও তুষার গলন সীমিত হওয়ায় পানির স্তর ২০-২৫ শতাংশ কমে গেছে।
বিডি-প্রতিদিন/শআ