মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থীদের স্বজনদের কান্নায় গতকাল ভারী হয়ে উঠেছিল জাতীয় প্রেস ক্লাবের মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ হল। প্রিয় সন্তানের স্মৃতিচারণ করে হু-হু করে কেঁদে ওঠেন তাদের স্বজনরা। এ সময় চোখ মুছতে দেখা যায় অন্যদেরও। নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ, এতগুলো বাচ্চা মারা যাওয়ার পরেও কেউ কথা বলেন না এটা নিয়ে। সন্তানের অকাল মৃত্যুর বিচার চাইলে বলা হয়-আমরা নাকি টাকার জন্য মায়াকান্না করছি।
‘যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারের সদস্যদের মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষের হয়রানি, দাবির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ, সামাজিক ও গণমাধ্যমে মানহানিকর বক্তব্য এবং মিথ্যাচারের প্রতিবাদসহ নয় দফা দাবি’তে গতকাল বিকালে সংবাদ সম্মেলন করেন নিহতের অভিভাবকরা।
অশ্রুভেজা চোখে যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় নিহত মারিয়াম উম্মে আফিয়ার মা উম্মে তামিমা আকতার বলেন, ‘বিমান যখন ক্রাশ হয়েছে আমি সবার আগে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিলাম। আমার চোখের সামনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল, তখন নিমিষেই শেষ হয়ে গেছে আমার স্বপ্ন। আমি সেখানে উপস্থিত থেকেও আমি কিছু করতে পারিনি। এটা নিয়ে আমি যখন কথা বলি তখন স্কুল প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়-‘আমি নাকি টাকার জন্য মায়াকান্না করছি।’ বাচ্চা মারা গেছে এর বিচারের জন্যও কি আমরা কথা বলতে পারব না? তিনি বলেন, এই মাইলস্টোন স্কুল কোচিংয়ের জন্য অনেক চাপপ্রয়োগ করত! মারা যাওয়া শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ের জন্যই আটকে রাখা হয়েছিল। আর এর কারণেই মারা গেল শিশুরা।
তামিমা আকতার বলেন, ‘সম্প্রতি স্কুলের নিহত তিন শিক্ষকের অভিভাবকদের নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক করেছেন। কিন্তু এ সময় আমাদের মারা যাওয়া বাচ্চা নিয়ে তো কোনো কথা বললেন না! আমরা যখন এই খবর দেখেছি আমাদের অনেক খারাপ লেগেছে। আমাদের বাচ্চাগুলোর কী কোনো দাম নেই তার কাছে? এই বাচ্চাগুলো তো বেঁচে থাকলে রাষ্ট্রের অনেক বড় বড় জায়গায় যেতে পারত! তারা হয়তো এ রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারত! প্রতিটি বাচ্চারই তো স্বপ্ন ছিল বড় হওয়ার। একবারও কি তার মনে হলো না যে, মারা যাওয়া বাচ্চাদের অভিভাবকদের সঙ্গেও কথা বলি। কিন্তু তিনি এটি করেননি। তাহলে আদৌ কী আমরা আমাদের সন্তানদের বিচার পাব? পুরো জাতির কাছে আমার এই প্রশ্ন। এতগুলো বাচ্চার জন্য কী আপনাদের একটুকুও খারাপ লাগেনি? এতদিন হয়ে গেল, কিন্তু কেউ কোনো কথা বলেন না এটা নিয়ে।’
নিহত তানভির আহমেদের বাবা রুবেল মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করত। প্রতিদিনের মতো আমার দুই ছেলেকে লেখাপড়ার জন্য মাইলস্টোন স্কুলে পৌঁছে দিয়েছিলাম। ভাগ্যক্রমে ছোট ছেলেকে ফিরে পেলেও বড় ছেলেকে ফিরে পাইনি। আমার সন্তান সেদিন সব ক্লাস শেষ করে কোচিংয়ের জন্য স্কুলের বারান্দায় অপেক্ষা করছিল। আর তানভিরের মা খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছিল কখন তার ছেলে স্কুল থেকে ফিরবে। কিন্তু তার ঘরে ফেরা হয়নি। তানভির বড় হয়ে বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে চেয়েছিল। তার স্বপ্নও নিমিষেই শেষ হয়ে গেছে। তার অকাল মৃত্যুর দায়ভার কে নিবে? সরকার, বিমানবাহিনী নাকি মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষ? সবাই গা বাঁচিয়ে চলছে। আমি কি আমার বাচ্চার মৃত্যুর বিচার পাব না? এমন পরিস্থিতিতেও মাইলস্টোনের মালিক নুরুন নবী (অ্যাডভাইজার, নুরুন নবী) নিহত সন্তানদের অভিভাবকদের বলির পাঠা বানাতে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিতে চেয়েছেন। আমরা অস্বীকৃতি জানালে আমাদের স্কুলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলেন, মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষ শিক্ষার নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন। বিমান দুর্ঘটনার দিনেও তিনি কোনো পরিবহন ব্যবস্থা রাখেননি দগ্ধদের বাঁচাতে।’
আশরাফুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার দুই সন্তান মারা গেছে। কোচিং বাণিজ্যের টাকা স্কুলের সবাই ভাগাভাগি করে খান। আমার স্ত্রী এ ঘটনায় এখনো হাসপাতালে ভর্তি। দেশবাসীর কাছে সন্তান মৃত্যুর বিচার চাই। যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনার সময় যখন ছোট্ট ছেলেরা অগ্নিদগ্ধ হয়ে হেঁটে বের হচ্ছিল তখন স্কুলের শিক্ষকরা তাদের ধরেননি। মাইলস্টোন স্কুলে শিক্ষক নামের অনেক কুলাঙ্গারও আছে।
নিহত মাহতাব ভূঁইয়ার বাবা মিনহাজুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘ছেলে মারা গেছে এরপর থেকে কোথাও মন বসে না, কাজে যেতে পারি না। মেধাবী শিক্ষার্থীদের জোর করে কোচিং করায় এমন নজির কোথাও নেই। আমি সুষ্ঠু তদন্ত করে এর বিচার চাই।’
নিহত জারিফ ফারহানের বাবা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এই স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করে অসহায় হয়ে গেছি। আর কারও সন্তান যেন এমন বলির শিকার না হয়।’ যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থী ফাতেমা আক্তার, নুসরাত জাহান আনিকা, সায়মা আক্তার, মাহিত হাসান আরিয়ান, বোরহান উদ্দিন বাপ্পি, জারিফ ফারহানসহ সবার ছবিসংবলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন তাদের স্বজনরা।
সংবাদ সম্মেলনে নিহতদের অভিভাবকরা ৯ দফা দাবি তুলে ধরেন। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন নিহত ফাতেমা আক্তারের মামা লিয়ন মীর, নিহত মারিয়াম উম্মে আফিয়ার মা উম্মে তামিমা আকতার ও নিহত তানভির আহমেদের বাবা রুবেল মিয়া।
এই ৯ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে-আইন অমান্য এবং নিয়ম ভঙ্গ করে কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে শিশুদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার দায়ে মাইলস্টোনের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার নিশ্চিত করতে হবে; মাইলস্টোনসহ সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে; নিহত পরিবারগুলোকে মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষকে আর্থিক জরিমানা দিতে হবে; রানওয়ে এলাকা থেকে মাইলস্টোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামক কোচিং সেন্টার স্থানান্তর করতে হবে।
তাদের দাবির মধ্যে আরও রয়েছে-মাইলস্টোনে কোচিং বাণিজ্যের মূল হোতাদের দ্রুত অপসারণ করে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে; সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রদানকারী শিক্ষকদের অপসারণ এবং আইনের আওতায় আনতে হবে; নিহত পরিবারের সদস্যদের হয়রানি বন্ধে সরকারকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; ঘটনার প্রকৃত চিত্র জানাতে মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষকে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ প্রকাশ করতে হবে; জনস্বার্থে রিটকারী আইনজীবীর রিট অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণের রিট বাস্তবায়ন করতে হবে এবং বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জনহীন এলাকায় স্থানান্তর করতে হবে।