লুটপাটের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা অর্থ, সম্পদ ও শেয়ার ব্যবস্থাপনায় একটি তহবিল গঠন করবে সরকার। এ তহবিলের অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংক ও আমানতকারীদের ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি দরিদ্র জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হবে। এ ছাড়াও জব্দ করা এস আলম গ্রুপের ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার হস্তান্তর করে পাওয়া অর্থ আমানতকারীদের ফেরত দেওয়া হবে। গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। তার আগে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমরা এ তহবিল গঠন করে সরকারের কাছে দেব। যাতে পরবর্তী সরকারও এ তহবিল কার্যকরভাবে ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করতে পারে। আত্মসাৎকারীদের কাছ থেকে জব্দ করা অর্থ, সম্পদ ও শেয়ারগুলো প্রথমে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোতে ফেরত দেওয়া হবে, যেখান থেকে এসব টাকা অবৈধভাবে উত্তোলন করা হয়েছিল। পরে তহবিল থেকে ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেবে। বাকি অর্থের একটি অংশ দরিদ্র জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হবে। গভর্নর বলেন, এস আলম গ্রুপের ইসলামী ব্যাংকের ১২ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার শেয়ার জব্দ আছে। এ শেয়ার স্ট্র্যাটেজিক বিনিয়োগকারীর কাছে হস্তান্তর করে পাওয়া অর্থ আমানতকারীদের ফেরত দেওয়া হবে। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে একটা তহবিল গঠন করে ব্যাংকগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া। কারণ ব্যাংকগুলোর বড় অঙ্কের ক্ষতি হয়েছে। ব্যাংকের টাকা লুট করা হয়েছে। এ ছাড়া বাকি অর্থের যেগুলো ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক নেই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা হয়েছে, সেগুলো সরকার আরেকটা তহবিলে নিয়ে জনহিতকর কাজে ব্যয় করবে। সবই আইনগতভাবে করা হবে।
প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ১১টি আন্তসংস্থা টিমের তদন্তাধীন ব্যক্তিদের ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা, বৈদেশিক সংযুক্ত ১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার এবং ৪২ হাজার ৬১৪ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ রয়েছে। এদের ১২৫টি অনিয়ম আইনের আওতায় এসেছে। ২০টি বিদেশি আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যপরিধি ঠিক করা হচ্ছে। জব্দ করা অর্থ-সম্পদ থেকে ‘লুটের টাকা ব্যবস্থাপনা তহবিল’ নামে একটি তহবিল গঠন হবে। আদালতে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগে কোন আইনে অর্থ-সম্পদ-শেয়ার জব্দ করা হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, অবশ্যই আমরা এটি আইনগতভাবে করব। এতে কোনো আইনের ব্যত্যয় হবে না। আদালতের সিদ্ধান্ত হওয়ার পরে এবং আইনের সঠিক ধারা প্রয়োগের মাধ্যমেই করা হবে। প্রয়োজনে আইন কিছু সংশোধন করতে হতে পারে। এটা নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় এবং অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় কাজ করবে।
পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে আপনারা যে উদ্যোগ নিয়েছেন, এটি কত দিনের মধ্যে সম্পন্ন হতে পারে? এখন পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে যেসব টাকা লুটপাট হয়েছে, জানা মতে সাবেক গভর্নর এবং কয়েকজন ডেপুটি গভর্নর এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের বর্তমান অবস্থা কী? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আহসান এইচ মনসুর বলেন, পাচার হওয়া টাকা কীভাবে ফেরত আনতে হয়, সে বিষয় কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল এক্সপেরিয়েন্সটা আমরা জানি। সাধারণত এটি করতে ৪ থেকে ৫ বছর সময় লাগে। কিন্তু এর মধ্যে ইমিডিয়েট কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যায়। বিদেশে তাদের যে সম্পদ আছে, সেটাকে ফ্রিজ করা যায়। সেটা আপেক্ষিকভাবে বছরখানেকের মধ্যেই করা সম্ভব। প্রথমে আইনের প্রক্রিয়াটা আমাদের দেশে সম্পন্ন করতে হবে, তারপর সঠিক প্রক্রিয়ায় বিদেশে অনুরোধ করতে হবে। যেটাকে বলা হয়, মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স (এমএলএ)। আমরা এখন এই প্রক্রিয়াতে আছি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে যদি দুর্নীতি হয়ে থাকে তাহলে দুদক সেটা তদন্ত করবে। কোনো নাম চার্জশিটে আনা গেলে নিয়ে আসবে। এখানে দুদককে কেউ বাধা দিচ্ছে না। দুদক নিজস্ব প্রক্রিয়ায় তদন্ত করছে। মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান নগদের সাবেক ম্যানেজমেন্ট প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে এবং পুনরায় নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, আপাতত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কথা বলে নগদ থেকে টাকা জমা ও উত্তোলন ছাড়া অন্য সেবা বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন যারা এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন আগের অর্থে তারা যেন এক্সেস না পান (প্রবেশাধিকার) সে ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে। যারা দেশ থেকে অর্থ পাচার করেছে তারা শান্তিতে থাকতে পারবেন না জানিয়ে গভর্নর বলেন, আমরা শুনেছি, এস আলম তার আইনজীবীর পেছনে বছরে ৩ কোটি ডলার ব্যয় করবেন। এটা তার শান্তিতে থাকার লক্ষণ নয়।