দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রায় নয় মাস ধরে অন্তর্বর্তী সরকারকে যে বিষয়গুলো সামলাতে সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে তার মধ্যে শ্রমিক অসন্তোষ অন্যতম একটি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন কারখানা একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে নিয়মিত বেতন-ভাতা না পেয়ে যে শ্রমিক অসন্তোষ তৈরি হয় তা সামাল দিতে পারছে না সরকার। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শ্রমজীবী মানুষের বড় ভূমিকা থাকলেও তাঁদের মূল সমস্যাগুলো সমাধান বা তাঁদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে না কাউকে। উল্টো শ্রমিক অসন্তোষ দমাতে গিয়ে আশুলিয়ায় ও মিরপুরে শ্রমিকদের ওপর নির্বিচার গুলি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বর্তমানে ১ লাখের বেশি শ্রমিক বেকার। শ্রমিকদের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তার কোনোটিই কার্যকর হয়নি বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান শ্রমিকনেতারা। সর্বশেষ শ্রমিকদের স্বার্থে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বিভিন্ন সুপারিশ করা হলেও এগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে তাঁরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
শ্রমিকনেতারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে গতকাল বলেন, বর্তমানে দেশে সবচেয়ে বড় বৈষম্যের শিকার শ্রমিকরা। এটি অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। ২০২৪-এর আন্দোলনে অনেক শ্রমিক জীবন দিয়েছেন, কিন্তু আন্দোলনের নয় মাস পরেও শ্রমিকের অবস্থা ও ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এমনকি নিহতদের তালিকায় নামও নেই। তবে শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন না হলেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের।
গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি শ্রমিকনেতা মোশরেফা মিশু গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ সরকার আশুলিয়ার দুটি ও মিরপুরের একটি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দমাতে গুলি করে। গুলিতে আশুলিয়ায় নিহত শ্রমিকের নাম মো. কাওসার। গত অক্টোবরে আশুলিয়ার আরেক কারখানায় গুলি করে চম্পা খাতুন নামে এক নারী শ্রমিককে হত্যা করা হয়। অক্টোবরের ৩০ তারিখে মিরপুরে আরেক কারখানায় শ্রমিকদের ওপর গুলি চালালে শ্রমিকরা মারাত্মক আহত হন। আজ এটা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক যে জুলাই আন্দোলনে অনেক শ্রমিক জীবন দিয়েছেন, কিন্তু আন্দোলনের নয় মাস পরেও শ্রমিকের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘শ্রমিকের ভাগ্যের পরিবর্তন না হলেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে ছাত্রনেতাদের। যে ছাত্ররা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁরা এখন সরকারের বড় পদে আছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে এ আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকরা একই রকম বৈষম্যের শিকার এখনো রয়ে গেছেন।’
অবস্থার পরিবর্তন হয়নি শ্রমিকের : বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মোট ৭৩৬ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আহত হন ৩০০ জন। নিহতের মধ্যে দুজন নারী। এ সময় সবচেয়ে বেশি ২৯২ জন পরিবহন খাতের শ্রমিকের মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় কৃষি খাতে। এরপর ৯৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় নির্মাণ খাতে। এ সময় কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হন ২৬৪ জন। এর মধ্যে নারী শ্রমিক ৩৮ জন। সবচেয়ে বেশি ৪৪ জন অটোরিকশা শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন। এরপর তৈরি পোশাক খাতে নির্যাতনের শিকার হন ৩৬ জন শ্রমিক। ১৬ জন গৃহশ্রমিক কাজ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে নয়জন নিহত এবং সাতজন আহত হন। নির্যাতিত শ্রমিকের বেশির ভাগই শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, ছুরিকাঘাত, খুন, অপহরণ ও মারধরের শিকার।
বিলসের তথ্যে, ২০২৪ সালে মোট ৫০১টি শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৪০৬টিই তৈরি পোশাক খাতের। বকেয়া বেতনের কারণে ১৫৫টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে। বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে ৯৫টি অসন্তোষের ঘটনা, দাবি আদায়ে ৯৩টি ঘটনা, লে-অফের জন্য ৮৭টি অসন্তোষের ঘটনা, বেতন বৃদ্ধির জন্য ৩৩টি ঘটনা, ওভারটাইমের দাবিতে সাতটি, বোনাসের দাবিতে ছয়টি এবং শ্রমিক মৃত্যুর জন্য দুটি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে। এসব আন্দোলনে পাঁচজন শ্রমিক নিহত হন।
শ্রমিকনেতারা জানান, শ্রমিকের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত। শ্রমঘন এলাকাগুলোয় এখনো পর্যাপ্ত হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়নি। শ্রমিকের জন্য এখনো ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থা করা যায়নি। আবার বিপজ্জনক কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের জন্য নিরাপত্তা সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা এখনো করতে পারেনি রাষ্ট্র ও মালিকপক্ষ। শ্রমিকের জন্য শ্রমিকনেতারা দুর্ঘটনা বিমা ও এমপ্লয়ার্স ইনজুরি স্কিম চালু করার দাবি জানান। আবার দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা চা শিল্পের শ্রমিকের সমস্যাগুলোরও এখনো স্থায়ী ও কার্যকর সমাধান হয়নি। পরিবহনশ্রমিকের জন্য নেই নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা ও বিশ্রামের সুযোগ। হোটেল-রেস্টুরেন্টে কর্মরত শ্রমিকের জন্য এখনো বাধ্যতামূলক নিয়োগপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়নি। তাঁদের নেই কোনো সাপ্তাহিক ছুটি, উৎসবভাতা। এ খাতে হচ্ছে যথেচ্ছ শিশুশ্রম। এখনো গৃহশ্রমিককে শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায়নি। একই সঙ্গে ‘গৃহকর্মী কল্যাণ ও সুরক্ষা নীতিমালা, ২০১৫’-এর বাস্তবায়নও নেই। এখনো ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুদের গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করানো হচ্ছে এবং তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
জুলাই অভ্যুত্থানে উৎসর্গ করেছেন ১১৪ শ্রমিক : দেড় হাজারের বেশি শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে গত আগস্টে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন ঘটে। ছাত্র-জনতার পাশাপাশি এ আন্দোলনের সম্মুখসারিতে ছিলেন শ্রমিকরাও। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিভিন্ন পেশার শ্রমিকরা ছাত্র-জনতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে শামিল হন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যানুযায়ী, আন্দোলনে প্রাণ হারান ১১৪ জন শ্রমিক। আহত হন আরও ২৯ জন।
নিহত শ্রমিকরা হলেন রংপুরের দোকান কর্মচারী মিলন মিয়া, যাত্রাবাড়ীর হোটেল কর্মচারী আরিফ, বাড্ডার নির্মাণশ্রমিক গণি শেখ, রামপুরার বিদ্যুৎশ্রমিক গোলাম রাব্বি রাকিব, বাড্ডার ডেলিভারিম্যান সোহাগ, রায়েরবাগের বিদ্যুৎশ্রমিক মোবারক, গোলাপবাগের পরিবহনশ্রমিক আবু জাফর, আজিমপুরের রিকশাচালক মোহাম্মদ আলী, রংপুরের রিকশাচালক মানিক মিয়া, মিরপুরের পরিবহনশ্রমিক দুলাল মতিউর, গুলিস্তানের দোকান কর্মচারী সিয়াম, বগুড়ার দোকান কর্মচারী সিয়াম হোসেন, চট্টগ্রামের দোকান কর্মচারী ফারুক, নিউমার্কেটের হকার মো. শাহজাহান, ঢাকার দোকান কর্মচারী ইমরান, ঢাকার পোশাকশ্রমিক রাকিব, যাত্রাবাড়ীর পোশাকশ্রমিক আমিন, গাজীপুরের নির্মাণশ্রমিক নুর আলম, নারায়ণগঞ্জের দোকান কর্মচারী সজীব, সাভারের রিকশাচালক রনি, নির্মাণশ্রমিক মেহেদী হাসান, যাত্রাবাড়ীর ওয়ার্কশপ কর্মী আবদুল কাইয়ুম, গাজীপুরের পোশাকশ্রমিক রায়হান, যাত্রাবাড়ীর সেলসম্যান ইউসুফ, রিকশাচালক হাবিব সরদার ও আরিফ, যাত্রাবাড়ীর দোকান কর্মচারী সোহেল, বাড্ডার ওয়ার্কশপ কর্মী বাহাদুর হোসেন মনির, উত্তরার রিকশাচালক বকুল মিয়া, পরিবহনশ্রমিক আশাদুল হক, মাদারীপুরের পরিবহনশ্রমিক রোমান ব্যাপারী, নরসিংদীর পোশাকশ্রমিক আলী হোসেন, হকার নাহিদ, পান্থপথের হকার মোবারক, যাত্রাবাড়ীর ওয়ার্কশপ কর্মী আমিন, চাঁদপুরের পরিবহনশ্রমিক আবদুল মজিদ, নরসিংদীর দিনমজুর হাসান মিয়া, চট্টগ্রামের দোকান কর্মচারী সাইমন, ঢাকার দোকান কর্মচারী আকাশ, যাত্রাবাড়ীর রিকশাচালক জসিম, কাজলার হোটেল কর্মচারী আরিফ, শাহবাগের দোকান কর্মচারী পাভেল, নবাবপুরের দোকান কর্মচারী মোবারক হোসেন, গাজীপুরের দিনমজুর নুরুল আমিন, শনিরআখড়ার রাবার ফ্যাক্টরি শ্রমিক ইমন মিয়া, রামপুরার পরিবহনশ্রমিক আলমগীর, শনিরআখড়ার দোকান কর্মচারী ইয়াসিন, বাড্ডার নির্মাণশ্রমিক গোলাম রাব্বানী, ঢাকার পরিবহনশ্রমিক সোহেল রানা, ধানমন্ডির পরিবহনশ্রমিক টিটু, উত্তরার দোকান কর্মচারী জসিম, নারায়ণগঞ্জের ডেকোরেটর শ্রমিক আবদুস সালাম ও সেলিম ম ল, নরসিংদীর পোশাকশ্রমিক জামান মিয়া, রায়েরবাজারের দোকান কর্মচারী জাকির হোসেন, বাড্ডার বেকারি কর্মচারী আবদুল হান্নান, মিরপুরের পোশাকশ্রমিক আসিফুর রহমান, বাড্ডার পোশাকশ্রমিক ইয়ামিন, নারায়ণগঞ্জের পোশাকশ্রমিক রাসেল, বসিলার দোকান কর্মচারী আবু ছায়েদ, রায়েরবাগের দোকান কর্মচারী সোহেল মিয়া, মিরপুরের কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি শ্রমিক ফিরোজ তালুকদার, রংপুরের হকার সাজ্জাদ হোসেন, যাত্রাবাড়ীর নির্মাণশ্রমিক ফয়েজ, রামপুরার রিকশাচালক আমির তালুদকার, ময়মনসিংহের কৃষিশ্রমিক সাইফুল ইসলাম, মিরপুরের রেস্টুরেন্ট কর্মী সিয়াম, উত্তরার পোশাকশ্রমিক জাকির হোসেন, শনিরআখড়ার দোকান কর্মচারী জোবায়ের, নর্দার দোকান কর্মচারী মিজানুর রহমান মিলন, নরসিংদীর কৃষিশ্রমিক আবদুর রহমান, শনিরআখড়ার রিকশাচালক মো. আমিন, রামপুরার ডেলিভারিম্যান সোহাগ, নারায়ণগঞ্জের নির্মাণশ্রমিক সেলিম ম ল, সালাম ও সোহেল আহমেদ, ঢাকার সরকারি কর্মচারী আদি আল মাহমুদ, নারায়ণগঞ্জের মোটরশ্রমিক মোস্তফা কামাল রাজু, মহাখালীর সেলসম্যান শাহজাহান হৃদয়, যাত্রাবাড়ীর ইন্টারনেট-কর্মী সাজেদুর রহমান ওমর, সাভারের নির্মাণশ্রমিক তুহিন, নরসিংদীর ফয়েজ মিয়া, রিকশাচালক আশিকুল ইসলাম রাব্বী, ঝালমুড়ি বিক্রেতা নাহিদ মিয়া, দিনমজুর হাসান মিয়া, হৃদয় মীর, রিকশাচালক সুজন মিয়া, রামপুরার কারখানাশ্রমিক সেলিম তালুকদার, মহাখালীর ডেলিভারিম্যান আবদুর রহমান জিসান, মিরপুরের নাহিদুল ইসলাম, চিটাগাং রোডের মেকানিক জাকির হাসান, কদমতলীর মোবাইল সার্ভিসিং শ্রমিক সোহেল, উত্তরার পরিবহনশ্রমিক আসাদুল্লাহ, সিলেটের বিদ্যুৎকর্মী মোস্তাক আহমেদ, রামপুরার পোশাকশ্রমিক সোহান, গাজীপুরের পোশাকশ্রমিক মিনহাজ, রায়েরবাগের দোকান কর্মচারী জিসান আহমেদ, গাজীপুরের স্পিনিং মিলের কর্মী কাজল মিয়া, দোকান কর্মচারী জাহাঙ্গীর আলম, বাড্ডার হোটেলকর্মী ইমন, রায়েরবাগের কয়েল ফ্যাক্টরির কর্মচারী ওমর ফারুক, মিরপুরের নির্মাণশ্রমিক মিরাজ, গাজীপুরের দোকান কর্মচারী তোফাজ্জল, কুমিল্লার পরিবহনশ্রমিক আবদুর রাজ্জাক রুবেল, যাত্রাবাড়ীর পরিবহনশ্রমিক রিয়াজ উল্লাহ, রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বিদ্যুৎশ্রমিক জুয়েল, হাজারীবাগের দোকান কর্মচারী রিয়াজ উদ্দিন তালুকদার ও চানখাঁরপুলের টেইলার্স কর্মী তারেক।