১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে শহরে মাইকিং করে জানানো হয়, পাকিস্তানিরা ঢাকা আক্রমণ করেছে এবং সবাইকে কলেজ মাঠে আসার জন্য অনুরোধ করা হয়। পরে আমরা কলেজ মাঠে যাই। যুদ্ধের জন্য সেখানে আমাদের ট্রেনিং করানো হয়। সেখানে আমরা ৫০০-৬০০ ছাত্র ছিলাম। প্রথম দিকে হক সাহেব নামে এক আর্মি অফিসার, কলেজের খলিল ভাই এবং আমার বড় ভাই আলমগীর হোসেন আমাদের ট্রেনিং করান। বড় ভাই আলমগীর হোসেন ছিলেন বিমান বাহিনীর অফিসার। তিনি ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন। ট্রেনিংয়ের ১০ দিন শেষ হওয়ার পর কর্নেল শওকত স্যার আসেন। তিনি আমাদের ৫০০-৬০০ লোকের ভিতর থেকে ১৬৫ জনকে বাছাই করেন। আমাদের জানানো হয় আমাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণে একটি চরে নেওয়া হবে। পরের দিন সকালে উঠে আমরা কলেজ মাঠে আসলাম। পরে আমাদের লঞ্চে করে নিয়ে যাওয়া হয়। জানানো হয়, আমাদের চাঁদপুর নিয়ে যাওয়া হবে। আমরা চাঁদপুরের উদ্দেশে রওনা করি। আমাদের লঞ্চ যখন নীলকমল নামে একটি স্থানে যায় তখন সেখান থেকে আমাদের চাঁদপুর যেতে নিষেধ করা হয়। বলা হলো, চাঁদপুরে পাক সেনাবাহিনী আক্রমণ করেছে। তখন আমরা চৌমুহনী যাই। সেখান থেকে সোনাইমুড়ী যাই। সেখানেই জানতে পারি আমাদের ভারতে ট্রেনিংয়ের জন্য নেওয়া হবে। সেখান থেকে বেলুনিয়া বর্ডার পার হই। আমাদের সঙ্গে ছিলেন স্টুয়ার্ড মুজিব ভাই। সেই সময় আমাদের কাছে কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। তবে মুজিব ভাই তার স্ত্রীর কাছ থেকে সোনাদানা নিয়ে গিয়েছিলেন। সেগুলো বিক্রি করে আমাদের খাওয়াদাওয়া করালেন। এরপর সেখানে ভারতীয় ৩টি আর্মির গাড়ি আসে। সেই গাড়িতে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় পাহাড়ি এলাকায়। দুর্গম এলাকা পার হয়ে ত্রিপুরার আগরতলায় গেলাম। সেখান থেকে মেলাঘর নিয়ে আমাদের ট্রেনিং করায়। ট্রেনিং শেষে আমরা দেশে ফিরে আসি।
আমাদের মূল অস্ত্র ছিল গ্রেনেড। আমরা যখন মাদারীপুর ঢুকি তখনই শাহজাহান ও বাদল নামে দুই সহযোদ্ধা ধরা পড়ে। তারা ধরা পড়ার পর আমরা আর কেউ একত্রে মিলিত হতে পারিনি। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধা তসলিম ভাই একটা গ্রুপ নিয়ে আসেন। তিনি বিলের মধ্যে আস্তানা গড়েন। আমি চলে যাই তখন আমার ফুফুর বাড়ি ভাঙ্গা উপজেলার কালামৃধায়। তখন এক দিন আমার এক ফুফাতো ভাই জানান, কালামৃধায় মুক্তিযোদ্ধারা আসছেন। তখন খবর নিয়ে জেনেছি তারা পোদ্দারবাড়িতে ক্যাম্প করেছেন। তখন বর্ষাকাল। আমি নৌকা নিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। গিয়ে দেখি মোসলেম খান, রেজাউল তালুকদারসহ সবাই পরিচিত। এরপর তাদের সঙ্গে যোগ দিই। তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম শুরু করি। পরবর্তীতে মাদারীপুর চলে আসি।
এরই মধ্যে আমার বড় ভাই এড়িয়া কমান্ডার হিসেবে মাদারীপুরের দায়িত্ব পায়। তিনি ১৬৫ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে আসছিলেন। এদের মধ্যে ১০০ জন শরীয়তপুরে রেখে বাকি ৬৫ জন নিয়ে মাদারীপুর আসেন তিনি। আমাদের অস্ত্র কম, অস্ত্র লাগবে। অস্ত্রের জন্য সহযোদ্ধা খলিলকে ভারত পাঠানো হয়। এর মধ্যে দুই আড়াই মাস খলিলের খবর ছিল না। খবর না থাকাতে সবার ধারণা ছিল খলিল হয়তো মারা গেছে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, শ্রুতিলিখন : বেলাল রিজভী, মাদারীপুর