কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে দীর্ঘ সময় বক্তব্যে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ৪ মার্চ রাতে ক্যাপিটল হিলে ডেমোক্র্যাটদের নীরবতা আর রিপাবলিকানদের বিপুল করতালির মধ্যে টানা ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট ভাষণ দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এ সময় গত ৪৩ দিনে ১০০ নির্বাহী আদেশসহ ৪ শতাধিক প্রশাসনিক পদক্ষেপের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন তিনি। ইউক্রেন-রাশিয়া ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ পরিস্থিতির পাশাপাশি কানাডা, মেক্সিকো, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পণ্য আমদানিতে শুল্ক আরোপের সাফল্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি নির্মিত গাড়ি কেনার ওপর ট্যাক্স মকুফের প্রসঙ্গও উপস্থাপন করেন দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত রিপাবলিকান এ প্রেসিডেন্ট। একপর্যায়ে ডেমোক্র্যাটদের কটাক্ষ করে তিনি বলেন, তারা কখনো ট্রাম্পকে প্রশংসিত করতে অভ্যস্ত নন। এটা তাদের মুদ্রাদোষ কি না তা-ও জানতে চান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। অবশ্য বক্তব্যের সময় গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী টেক্সাসের ৭৭ বছর বয়সি ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান আল গ্রিন উচ্চৈঃস্বরে প্রতিবাদ জানাতে থাকলে স্পিকারের নির্দেশে সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস এসে তাঁকে বের করে দেন। এমন ঘটনা বিরল। আর এর মধ্য দিয়েই গণতান্ত্রিক রীতি লঙ্ঘনে ট্রাম্প প্রশাসনের মনোভাবের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটে বলে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। চেম্বারে ডেমোক্র্যাটরা ছিলেন একেবারেই নির্লিপ্ত, নীরবতায় আচ্ছন্ন, তবে চোখে মুখে ক্ষোভ ঢেকে রাখতে পারেননি। কোনো কোনো কংগ্রেসওম্যানের হাতে ছিল ‘সেইভ মেডিকেইড’, ‘মাস্ক স্টিলস’, ‘ফলস’ লেখা প্ল্যাকার্ড। ট্রাম্পের মিথ্যাচার এবং বাস্তবের সঙ্গে মিল না থাকা বক্তব্যের সময় সেগুলো আরও উঁচুতে ওঠানো হয়। মিশিগানের কংগ্রেসওম্যান রাশিদা তৈয়বের হাতে ছিল সবচেয়ে বড় একটি বোর্ড। তাতে লেখা ছিল ‘নিজের ট্যাক্স যথাযথভাবে প্রদানের পর অন্য কিছু শুরু করুন।’ ট্রাম্প তাঁর ব্যবসায়িক ট্যাক্স প্রদানে শুভংকরের ফাঁকিতে লিপ্ত ছিলেন, সেদিকে ইঙ্গিত করেন রাশিদা তৈয়ব। ট্রাম্পের অসংলগ্ন বক্তব্যের প্রতিবাদে ফ্লোরিডার কংগ্রেসম্যান (ডেমোক্র্যাট) ম্যাক্সওয়েল ফ্রস্ট এবং টেক্সাসের কংগ্রেসওম্যান জেসমিন ক্রকেটসহ বেশ কজন ডেমোক্র্যাট চেম্বার ত্যাগ করেন অত্যন্ত নীরবে। সিনেটে বিরোধীদলীয় নেতা সিনেটর চাক শ্যুমার এবং প্রতিনিধি পরিষদে বিরোধীদলীয় নেতা হাকিম জ্যাফরি ছিলেন ক্ষুব্ধ, তবে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। গতানুগতিকভাবে ট্রাম্প তাঁর বিশেষ ব্যক্তি ধনকুবের ইলন মাস্কের প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়ে বড় অঙ্কের আর্থিক সাশ্রয় ঘটাতে সক্ষম হচ্ছেন মাস্ক, এমন অভিমতও পোষণ করেছেন ট্রাম্প। ইউএসএইডের অর্থ বন্ধের কথা বলার সময় অপ্রয়োজনে বহু দেশে বিপুল অর্থ ব্যয় বন্ধের ধারাবিবরণীতে অবশ্য এবার বাংলাদেশের সেই ২৯ মিলিয়ন ডলারের প্রসঙ্গ ওঠেনি। বিশ্বের অন্য সব দেশের কথা বলেছেন ট্রাম্প। ট্রাম্প দাবি করেন, ‘আমরা ৪৩ দিনে যতটা অর্জনে সক্ষম হয়েছি, এর আগে কোনো প্রেসিডেন্টই তাঁর পুরো চার বছর কিংবা আট বছর মেয়াদে সক্ষম হননি।’ ‘এবং এটি হচ্ছে আমাদের কেবল শুরু,’ উল্লেখ করেন ট্রাম্প। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে আর কোনো যুদ্ধসহায়তা না দেওয়ার সাময়িক সিদ্ধান্তের পরদিন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় রাজি হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এমনকি ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতেও সম্মত রয়েছেন জিলেনস্কি, উল্লেখ করেন ট্রাম্প। বক্তব্যের সময় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির একটি চিঠি পেয়েছেন তিনি আর তাতে ইউক্রেনীয় নেতা রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে আলোচনার টেবিলে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। ট্রাম্প ওই চিঠির লাইন উদ্ধৃত করে বলেন, ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তি নিকটতর করতে ইউক্রেন যত দ্রুত সম্ভব আলোচনার টেবিলে ফিরতে প্রস্তুত। শান্তি ইউক্রেনীয়দের চেয়ে বেশি আর কেউ চায় না।’
ট্রাম্প আরও জানান, তিনি ‘রাশিয়ার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায়’ আছেন আর তারা শান্তির জন্য প্রস্তুত আছে এমন জোরালো ইঙ্গিত পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এটি কি সুন্দর হবে না? এ পাগলামি বন্ধ করার সময় এখন। সময় এখন এসব হত্যাকা বন্ধ করার। সময় এখন এ অর্থহীন যুদ্ধ বন্ধ করার। যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইলে আপনার উভয় পক্ষের সঙ্গেই কথা বলতে হবে।’
তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে বড় এ যুদ্ধ কীভাবে শেষ করার পরিকল্পনা করেছেন তা প্রকাশ করেননি তিনি। ইউক্রেন তাদের মূল্যবান খনিজ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প। এ চুক্তিটি স্বাক্ষর করতেই শুক্রবার জেলেনস্কি ওয়াশিংটন এসেছিলেন। কিন্তু হোয়াইট হাউসের ওভাল দপ্তরে বিপর্যয়কর বৈঠকের পর খনিজ চুক্তি স্বাক্ষর করার পরিকল্পনা থমকে যায়।
এদিকে, কানাডা, মেক্সিকো এবং চীনের পণ্য আমদানিতে শুল্ক আরোপের ঘোষণার পরই অর্থাৎ নিকট ঘনিষ্ঠ মিত্র কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্টক মার্কেটে ধস নেমেছে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়াও নির্মাণ প্রকল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এমনি অবস্থা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর ভাষণে বলেছেন, আরও কটি দেশের পণ্য আমদানিতে শুল্ক আরোপের ঘটনা ঘটবে ২ এপ্রিল থেকে। কারণ, ওইসব দেশও নাকি যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানিতে বড় অঙ্কের কর ধার্য করেছে। দেশসমূহের মধ্যে ভারতও আছে বলে উল্লেখ করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ‘তাই যারা আমাদের পণ্য আমদানিতে চড়া শুল্ক আরোপ করেছে, তাদের পণ্যেরও শুল্ক দিতে হবে, এটা ভাইস ভারসা।’
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে বাজে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন জো বাইডেন’- এমন মন্তব্য বেশ কবার করেছেন ট্রাম্প। ট্রাম্প বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেনস্তার জন্য আইন-আদালত ব্যবহারেও দ্বিধা করেননি জো বাইডেন। আমি এখন তেমন অবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটাচ্ছি।’ ন্যায়ের শাসনের পথে হাঁটছে তার প্রশাসন, এমন দাবিও করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দক্ষিণের সীমানা খুলে দিয়ে বিদেশিদের অবাধে প্রবেশের সুযোগ দিয়েছিলেন জো বাইডেন ও কমলা প্রশাসন। এখন সেটি থামানো হয়েছে। অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কারের যে অভিযান চলছে তা আরও জোরদারের জন্য কংগ্রেসের কাছে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট তাঁর বক্তব্যে। ট্রাম্প দাবি করেন, গত ৪৩ দিনে যত অবৈধকে বহিষ্কার/গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ইতঃপূর্বে আর কখনো এমন নজির নেই। ডিমের মূল্য আকাশচুম্বী হওয়ার দায়ও বর্তেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ওপর। সেই মূল্য এখন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলেও দাবি করেন ট্রাম্প। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্যহ্রাসের কোনো পরিকল্পনা তাঁর বক্তব্যে ছিল না। যদিও কানাডা, মেক্সিকো, চীনের পণ্য আমদানিতে শুল্কারোপ/শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণা কার্যকর হওয়ার পরই বাজারে আগুন ধরেছে।