যুবসমাজের জন্য সর্বজনীন সামরিক প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দিয়েছেন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। এতে দেশের প্রতিরক্ষায় যুবসমাজ অংশ নিতে পারবে বলেও জানান তারা।
গতকাল ওসমানী মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক সম্মেলনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সশস্ত্রবাহিনী বিভাগসংক্রান্ত অধিবেশনে তারা এ প্রস্তাব দেন। অধিবেশন শেষে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবদুল হাফিজ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
আবদুুল হাফিজ বলেন, সিভিল-মিলিটারি কো-অপারেশন কীভাবে বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে জেলা প্রশাসকরা প্রশ্ন করেছিলেন। সিভিল প্রশাসনের অফিসাররা ডিভিশন পর্যায়ে যে ওরিয়েন্টেশন করেন, এরকম ওরিয়েন্টেশন করা সম্ভব কি না, যাতে সিভিল প্রশাসনের সঙ্গে সামরিক বাহিনী বা সশস্ত্র বাহিনীর বোঝাপড়া আরও বাড়ানো যায়। আমাদের যুবসমাজের জন্য একটি ইউনিভার্সেল মিলিটারি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় কি না, সে বিষয়েও প্রশ্ন ছিল ডিসিদের। এতে যুবসমাজ মিলিটারি ট্রেনিং পেতে পারে এবং দেশ প্রতিরক্ষায় অংশ নিতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী জানান, আমাদের চিফ অব জেনারেল স্টাফ বলেছেন, আমাদের আনসার-ভিডিপির মাধ্যমে প্রত্যেক উপজেলায় প্রত্যেক ইউনিয়নে একটা করে কোম্পানি অলরেডি ট্রেনিং দিচ্ছে। এটাকে আরও ব্যাপক আকারে করা যায় কি না সে বিষয়ে একজন ডিসি অনুরোধ করেছেন। আবদুল হাফিজ বলেন, এটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার, আর্থিক সংশ্লিষ্টতা আছে। চিন্তা করতেই পারি এবং যদি সরকার নির্দেশনা দেয়, তাহলে জনগণের সিদ্ধান্তই সরকারের সিদ্ধান্ত। নির্দেশনা পেলে আমাদের সশস্ত্রবাহিনী এটা করতে প্রস্তুত। তিনি জানান, বাংলাদেশ নেভির কাছে প্রশ্ন ছিল, জাটকাবিরোধী অভিযানের মাধ্যমে বা আমাদের নদীতে যে সম্পদ আছে সেই সম্পদ রক্ষায় তারা আরও ওতপ্রোতভাবে কীভাবে সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা করতে পারেন সে বিষয়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট যে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করছে, তার কারণে কয়েকটি জেলায় পর্যটনশিল্প ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে সেখানকার তরুণ প্রজন্ম কাজ হারাচ্ছে, চাকরি হারাচ্ছে এবং তারা সন্ত্রাসের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। সেখান থেকে কীভাবে উত্তরণ করা যায় সে-সংক্রান্ত প্রশ্ন ছিল ডিসিদের।
আবদুল হাফিজ বলেন, জেলা প্রশাসক হিসেবে আগামী দিনে কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সে বিষয়ে বলা হয়েছে। প্রায় ১ হাজার ৪০০ অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি, যেগুলো ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে লুট হয়েছিল। আড়াই লাখ গুলি এখনো উদ্ধার হয়নি। সেগুলো তাদের জেলায় কোনো না কোনো জায়গায় আছে। সেগুলো সন্ত্রাসীদের হাতে পড়তে পারে এবং তারা ব্যবহার করতে পারে। তিনি বলেন, আমি উল্লেখ করেছি, স্বৈরাচার এবং তাদের দোসররা বিভিন্ন জায়গায় একত্রিত হচ্ছে এবং কর্মসূচি দিচ্ছে। তারা দেশকে একটা অরাজকতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। রমজান মাসে সরকারকে ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হতে পারে বলে ডিসিদের সতর্ক করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, নিজ জেলায় দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখার চেষ্টার কথা বলা হয়েছে। বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিতে পারে, সেটা যাতে মোকাবিলা করা যায়। কৃষকরা যাতে সেচের উপকরণ এবং কৃষি উপকরণ সময়মতো পান সেসব বিষয় নিয়ে বলেছি।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আরও বলেন, নরসিংদীর ছয়টি ইউনিয়ন ও চরাঞ্চল দুর্গম। সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেসব জায়গায় স্পেশাল অপারেশন দরকার। এ সময় কোস্টগার্ডের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত কিছুদিন ধরে ইলিশের সরবরাহ বাজারে বেড়ে গেছে। মানুষ ইলিশ খেতে পারছে বা রপ্তানি হচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে কোস্টগার্ডের অপারেশনের কারণে।
ডিসিদের জনগণকে নিপীড়নে ব্যবহার করেছে ফ্যাসিস্টরা : জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) মেধাবী হিসেবে অভিহিত করে আইন, বিচার ও সংসদ এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, বিগত সরকারের আমলে দেশের সবচেয়ে মেধাবী ডিসিরা কাজ করেছেন। তবে ফ্যাসিস্ট সরকার তাদের জনগণের ওপর নিপীড়ন ও অত্যাচার করতে ব্যবহার করেছে। গতকাল রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ডিসি সম্মেলনের তৃতীয় দিনে কার্য-অধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন আইন উপদেষ্টা।
আসিফ নজরুল বলেন, ডিসি সম্মেলন আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। এটা খুব জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তারা মাঠ পর্যায়ে প্রশাসন দেখেন। আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কী কী সমস্যা আছে সেটা তাদের থেকে কেউ ভালো জানেন না। ডিসিরা জানিয়েছেন, দেশের বালুমহাল থেকে যারা বালু উত্তোলন করেন তাদের ধরা হলে তারা খুব দ্রুত জামিন পেয়ে যান। আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলো ডিসিদের জানিয়েছি। যেমন সরকারের অনেক মামলা থাকে, মামলার ক্ষেত্রে আমাদের যে উইং থাকে সেখানে তারা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে সেটা বলেছি। একই সঙ্গে তাদের ডিসি অফিসে যে আদালত রয়েছে সেখানে স্থান সঙ্কুলানের সমস্যা, সেটা নিয়ে কী করা যায় সে কথা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিগত সরকারের আমলে দেশের সবচেয়ে মেধাবী ডিসিরা কাজ করেছেন। রাষ্ট্রের এত বড় একটি রিসোর্সকে ফ্যাসিস্ট সরকার জনগণের ওপর নিপীড়ন করার জন্য, অত্যাচার করার জন্য, তাদের অপকর্ম জায়েজের জন্য ব্যবহার করেছে। তাদের এ শক্তিকে যদি জনগণের সেবার জন্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য, ভূমি ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসেবা প্রদান করার জন্য কাজে লাগাতে চায় সেই সক্ষমতা তাদের আছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যে দলই ক্ষমতায় আসুক প্রশাসন ক্যাডারের যে অসীম সম্ভাবনা রয়েছে, সেটাকে জনগণের নিপীড়নে কাজে না লাগিয়ে, সংবিধানে যেভাবে বলা আছে জনগণের সেবা করার কাজে যেন লাগায় সেটাই প্রত্যাশা।
ডিসিদের কী নির্দেশনা দিয়েছেন জানতে চাইলে ড. আসিফ নজরুল বলেন, আইনে যা আছে, নীতিমালায় যা আছে, সংবিধানে যা আছে সেটা মেনে চললে জনগণের সেবা আর কল্যাণ ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ নেই। কাজেই আমাদের শুধু একটা কথা বলেছি, আপনি আইন অনুযায়ী চলেন, বিবেক মতো চলেন। তাদের যে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সেটা সম্পূর্ণ আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করে।
র্যাব নতুন করে গঠন হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, দরকার হলে পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) নতুন করে গঠন করা হবে।
গতকাল সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা শেষে তিনি এ কথা বলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বৈঠকে র্যাব নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আমরা একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছি, মানে একটা আইডিয়া দেওয়া হয়েছে। র্যাবের নাম পরিবর্তন হবে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগামী সভায় এটা নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। সিদ্ধান্তটা আসলে কী, র্যাবকে নতুন করে গঠন করা হবে কি না- এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, হ্যাঁ, দরকার হলে এটা নতুন করে গঠন করা হবে।
এদিকে গতকাল রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের তৃতীয় দিনের কার্য অধিবেশন শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের বড় আশা হলো দেশ থেকে দুর্নীতি কমানো। দুর্নীতি না কমাতে পারলে দেশের অগ্রগতি হবে না। এটা সব পর্যায় থেকে কমিয়ে আনতে হবে, এ জন্য আমি ডিসিদের সহযোগিতা চেয়েছি। তিনি বলেন, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটামুটি সন্তোষজনক। আস্তে আস্তে এটি উন্নতির দিকে যাচ্ছে। সাংবাদিকরা পুলিশের হাতে মারণাস্ত্র না দেওয়া এবং এসপি ও ওসিদের এসআর লেখার প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এসব বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তারা (ডিসিরা) সীমান্ত এলাকায় বিজিবি বাড়ানোর জন্য বলেছেন। নৌপুলিশ বাড়ানোর জন্য বলেছেন। গাজীপুরে জনবল বাড়ানোর কথা বলেছেন। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশেও জনবল বাড়াতে বলেছেন। সাংবাদিকরা অপারেশন ডেভিল হান্ট কত দিন চলবে- জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, যতদিন ডেভিলরা থাকবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে সংসদ নির্বাচন নিয়ে ডিসিদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি বলেও জানান তিনি।
অন্যদিকে, সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে নির্বাচনে ডিসিদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন। তিনি বলেছেন, নির্বাচন ঘিরে ইসির যতটুকু ক্ষমতা আছে তার সর্বোচ্চটা প্রয়োগ করবে। আগামীর জাতীয় নির্বাচনে জেলা প্রশাসকদেরও আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল রাজধানীর ওসমানী উদ্যানে তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলনের শেষ অধিবেশনে এ কথা বলেন তিনি।