অল্প সময়ের মধ্যে চারবার ভূমিকম্প। এতে নরসিংদী ও ঢাকাসহ আশপাশের অঞ্চলের বাসিন্দারা বেশি চিন্তিত। এই ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের বার্তা দিচ্ছে, নাকি ঝুঁকি কিছুটা কমেছে? ভূমিকম্পগুলোর বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকিতে আছে তা নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ভূমিকম্পবিষয়ক গবেষক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খায়রুল কবির চৌধুরী
প্রশ্ন : অল্প সময়ের মধ্যে চারবার ভূমিকম্প। চারটিরই উৎপত্তিস্থল দেশের ভেতর- নরসিংদী ও ঢাকায়। এ ঘটনা কি আমাদের নতুন কোনো বার্তা দিচ্ছে?
উত্তর : প্রথমে বলি, শুক্রবার সকালে নরসিংদীর মাধবীদীতে সংঘটিত ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পটি হয়েছে ভারতীয় ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে। এই সংযোগস্থল বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হাওর হয়ে মেঘনা নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণে চলে গেছে, যাকে সাবডাকশন জোনও বলা হয়। সাবডাকশন জোনে একটা প্লেট আরেকটা প্লেটের নিচে তলিয়ে যায়। আমাদের এখানে সাবডাকশন জোনে ভারতীয় প্লেট বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। এখানে বিপুল শক্তি জমা হয়ে আছে, যা বের হওয়ার অপেক্ষায়। আমরা গবেষণায় দেখেছি, এই সাবডাকশন জোনে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়ে আছে। এখন শুক্রবার মাধবদীতে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের মানে হলো, লকড জোনের (বন্ধ জায়গার) একটা পয়েন্টে এটা খুলে গেল এবং কিছুটা শক্তি বের হলো। পরদিন শনিবার নরসিংদীতে সকালে ও সন্ধ্যায় যে দুটো ভূমিকম্প হলো, তা শুক্রবারের ভূমিকম্পের স্থানের উত্তরে হয়েছে। একই সরলরৈখিক পথে। দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে এগুলো পড়ছে।
প্রশ্ন : তারমানে সঞ্চিত বিপুল শক্তি এখন বের হওয়ার চেষ্টা করছে?
উত্তর : হ্যাঁ, ওখানে বিপুল শক্তিটা বের হওয়ার চেষ্টা করছে। এক জায়গায় সে একটু সামান্য ওপেন স্পেসে (ফাঁকা জায়গায়) বের হয়ে গেছে। পরদিন এর ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তরে সকালে ও সন্ধ্যায় আরো দুটো ভূমিকম্প হলো। এটা এই ইঙ্গিত দেয় যে, সঞ্চিত শক্তি তার বন্ধ পথ খোলার চেষ্টা করছে। এর মানে এর উত্তরে ও আরো দক্ষিণে সামনে আরো ভূমিকম্প হতে পারে। এটা কাল-পরশুই হবে এমন নয়, হয়তো ১০ দিন বিরতি দিয়েও হতে পারে। তারপর হয়তো সে যখন একটা প্রশস্ত রাস্তা পেয়ে যাবে এবং দুই প্লেটে আটকে থাকা শক্তিটা যখন কমে আসবে, তখন সে বৃহৎ শক্তিটা বের করে দেবে।
প্রশ্ন : কারো কারো মতে, আফটারশক মানে ভালো লক্ষণ যে, বড় একটা ভূমিকম্প হয়ে গেছে। এখন আপাতত আর বড় ভূমিকম্প হবে না। নরসিংদীর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কি তাই?
উত্তর : আমি আগেই বলেছি, সাবডাকশন জোনে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়ে আছে। তারই লক্ষণ আমরা দেখলাম (নরসিংদীতে) গত তিনটি ভূমিকম্পে। খেয়াল করুন, কোথায় ভূমিকম্প হবে, এর কাঠামো ও উৎস কোথায় সেটা আমরা বের করতে পারছি। সেই উৎস কী পরিমাণ শক্তি জমা হয়ে আছে তাও আমরা পরিমাপ করেছি। সেই উৎস থেকেই ছোটখাটো দু-একটা ভূমিকম্প হলো। যে শক্তিটা বের হয়েছে তা ০.১ শতাংশ বা তারও কম। তার মানে বিপুল শক্তি এখনো জমা আছে। তাহলে এভাবে চিন্তা করলে হবে না যে, ভবিষ্যতে আর ভূমিকম্প হবে না। বরং ভবিষ্যতে বড় ভূমিকম্প হবে, তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে এই ভূমিকম্প।
প্রশ্ন : শুক্রবার যদি ৫.৭ মাত্রার না হয়ে আরো বড় ভূমিকম্প হতো সে ক্ষেত্রে কি হতো?
উত্তর : হ্যাঁ, শুক্রবার যদি ৬.৫ বা ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হতো, তখন আমি বলতাম, সঞ্চিত শক্তির ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ বের হয়ে গেছে, সামনে খুব একটা ভূমিকম্প হবে না, হয়তো কিছু আফটারশক হবে।
প্রশ্ন : এটা কি অনুমান করা যায়, যে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা কোথায়, কখন হতে পারে বা কোন জায়গাটা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?
উত্তর : এটা যেহেতু নরসিংদীতে শুরু হয়েছে, সেখানকার উৎপত্তিস্থল থেকে উত্তর ও দক্ষিণে ১৫, ২০ বা ৩০ কিলোমিটার জায়গা নিয়ে সঞ্চিত শক্তিটা বের হতে পারে।
প্রশ্ন : এটা তো তাহলে নরসিংদী ও আশপাশের অঞ্চল বিশেষ করে ঢাকার জন্য উদ্বেগজনক?
উত্তর : নিঃসন্দেহে।
প্রশ্ন : নরসিংদীর আশপাশেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি কেন?
উত্তর : সিলেট থেকে চট্টগ্রাম প্রায় ২৫০ কিলোমিটারের পুরো অংশেই এই শক্তিটা জমা হয়ে আছে। এই সঞ্চিত শক্তি বের হওয়ার জন্য একটা পথ খুঁজছে। এখন এ প্রক্রিয়ায় সব জায়গায় তো আর শক্তিটা সমান না। সেটা আমরাও জানি না যে, কোন জায়গায় কেমন শক্তি। এটা প্রকৃতি জানে। তো প্রকৃতি এখন যেখানে একটু খোলা আছে সেখান দিয়ে শুরু করবে। তারপর ওখান থেকে ডানে-বামে বিস্তৃত হবে। আবার হয়তো ওখান থেকে একটু ভিন্ন জায়গায় কাছাকাছি কোনো অঞ্চলেও হতে পারে।
প্রশ্ন : ঢাকার ভেতর ও আশপাশে ঘনঘন ভূমিকম্প দেখছি। এর মানে কি ঢাকায় নতুন কোনো ফাটলরেখা তৈরি হচ্ছে?
উত্তর : ভূমিকম্পের যে শক্তি জমা হয়ে গেছে, তা আজ হোক, কাল হোক, বের হতেই হবে। সেই শক্তিটা বের হয় ফাটল দিয়ে। এখন এটা আগে যদি কোনো ফাটল থাকে, তা দিয়েও বের হতে পারে। আবার নতুন ফাটল তৈরি করেও বের হতে পারে। এটা অনেকটা ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ বিতর্কের মতো।
প্রশ্ন : ভূমিকম্প থেকে বাঁচতে বা ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি কমাতে করণীয় কী?
উত্তর : আমি বরাবরই সচেতনতা ও প্রস্তুতির ওপর জোর দিয়ে আসছি। ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে, কিভাবে নিরাপদ থাকতে হবে, তাৎক্ষণিকভাবে কোথায় আশ্রয় নিতে হবে, বড় ভূমিকম্প হয়ে যাওয়ার পর আফটারশকের ঝুঁকি এড়াতে কী করতে হবে-এসব বিষয়ে নাগরিকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রশিক্ষণ ও মহড়ার বিকল্প নেই। দেশের অনেক মানুষই এখন স্মার্টফোনে অভ্যস্ত। আমরা ভূমিকম্প বা অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো নিয়ে ন্যাচারাল হ্যাজার্ড গেম তৈরি করতে পারি এবং এর মাধ্যমে সুরক্ষা ও বাঁচার প্রস্তুতি সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করতে পারি।
সৌজন্যে - কালের কণ্ঠ।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ